আন্তর্জাতিক

গৃহযুদ্ধের পথে ভারতের প্রতিবেশী এই দেশ, অহিংস প্রতিবাদ থেকে সশস্ত্র প্রতিরোধের অনিশ্চিত দেশবাসী

ঠিক এক বছর আগে ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন মিয়ানমারের সেনাবাহিনী যখন নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা নিল, তাৎক্ষণিকভাবে জনগণের মধ্যে প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছিল সামান্যই।

অং সান সু চি, যার নেতৃত্বে গত তিন দশক ধরে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে ছিল মিয়ানমারের মানুষ, তাকেও গ্রেপ্তার করা হল।

আসলে কী করা উচিত, সেটাই তখন বুঝে উঠতে পারছিলেন না দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দেশটির নাগরিকরা।

“সেদিন সকালে ইন্টারনেট আর ফোনের লাইন বন্ধ করে দিল। আমরা প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না খবরটা। কিন্তু পরে যখন রেডিও কিনতে বের হলাম, বুঝতে পারলাম, আসলেই একটা সেনা অভ্যুত্থান হয়ে গেছে।”

এক বছর আগের সেই দিনের কথা এভাবেই বিবিসিকে বলছিলেন ইয়াংগনের শ্রমিক নেতা মোয়ে সান্দার মিন্ত।

“আসলে আমরা একেবারে ভেঙে পরেছিলাম। আমাদের জন্য সেটা ছিল অন্ধকার এক দিন। মিয়ানমার তো সবে উন্নতির পথে যাত্রা শুরু করেছিল। ওই অবস্থায় কীভাবে জান্তার বিরুদ্ধে লড়াই করব, সেটা ঠিক করাই আমাদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।”

১ ফেব্রুয়ারি ২০২০, দিনের শেষভাগে সু চির একটি লিখিত বার্তা প্রকাশ করা হল; সেখানে মিয়ানমারের জনগণকে আহ্বান জানানো হল- ‘এই অভ্যুত্থান মেনে নেবেন না’।

একই সময়ে সু চির সবচেয়ে বিশ্বস্ত উপদেষ্টা উইন থেইন তুলে ধরলেন মহাত্মা গান্ধীর উদাহরণ; আহ্বান জানালেন অসহযোগ আন্দোলনে নামার। সু চির দীর্ঘদিনের অহিংস আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই তিনি সেই ডাক দিয়েছিলেন।

এভাবেই জন্ম নেয় সিডিএম- ক্যাম্পেইন ফর সিভিল ডিজঅবিডিয়েন্স। শুরুর দিকে স্বাস্থ্যকর্মী ও শিক্ষকরা কাজে যেতে অস্বীকৃতি জানালেন। দ্রুতই সরকারি কর্মচারী, শ্রমিক ইউনিয়ন এবং সংগীত শিল্পী, চলচ্চিত্র তারকা, এলজিবিটি আন্দোলনের কর্মীরা এবং জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলো যোগ দিল তাতে।

তারা শুধু সু চির অহিংস আন্দোলনের ডাকে সমর্থনই দিলেন না, সর্বত্র আন্দোলনের মুখ হয়ে উঠলেন কারাবন্দি এই নোবেলজয়ী নেত্রী। তার নেতৃত্বাধীন সরকারকে পুনর্বহালের দাবি জানানোও শুরু করল আন্দোলনকারীরা।

অভ্যুত্থানের চার দিন পর প্রথম বড় আকারে প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করেন মোয়ে সান্দার মিন্ত। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে গড়ে ওঠা আন্দোলনে এ ধরনের বহু সমাবেশ হয়েছে গত এক বছরে। অভ্যুত্থানের পর প্রথম মাসে রাজপথে এসব সমাবেশ অনেকটা উৎসবের পরিবেশ সৃষ্টি করত।

মোয়ে বলেন, “আমি উদ্বেগে থাকতাম কখন আমার কর্মীরা না জানি গুলি খায়। কিন্তু সমাবেশগুলোতে আশাতীত সংখ্যক মানুষের অংশগ্রহণ আমার সব ভয় দূর করে দিয়েছিল।”

মোয়ে এখন তার স্বামী ও তিন সন্তানকে নিয়ে থাইল্যান্ডে নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছেন। ইয়াংগন প্রথমে পালিয়ে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত সীমান্ত এলাকায় পৌঁছান তারা। ওই এলাকা সংখ্যালঘু বিদ্রোহী গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে। সেখান থেকে রাতের আঁধারে তারা সীমান্ত পার হন।

বিবিসি লিখেছে, ওই আন্দোলনের মোড় ঘুরে যাওয়ার সময়টি ছিল গত মার্চে, যখন সামরিক জান্তা প্রতিবাদকারীদের গুঁড়িয়ে দিতে সৈন্যদের নির্দেশ দেয়।

মোয়ে সান্দার মিন্ত প্রথম সংঘাতের মধ্যে পড়েন ১৪ মার্চ। ততোদিনে গ্রেপ্তার এড়াতে তিনি বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে থাকতে শুরু করেছেন।

ঘটনাটা ইয়াংগনের অভিবাসী শ্রমিক অধ্যুষিত ঘনবসতিপূর্ণ হ্লায়িং থারিয়ার এলাকায়। ‘কঠিন জায়গা’ হিসেবে ওই এলাকা ততদিনে পরিচিতি পেয়েছে। সৈন্যদের ঠেকাতে ওই এলাকার বাসিন্দারা রাস্তায় ব্যারিকেড তৈরি করেছিল।

মোয়ে বলেন, “আমি অন্য ইউনিয়ন নেতাদের সঙ্গে মিলে আমাদের পরের পদক্ষেপের পরিকল্পনা করছিলাম। হঠাৎই শুনতে পেলাম সৈন্যরা আসছে, আমরা ছড়িয়ে পড়লাম। ওরা হ্লায়িং থারিয়ার থেকে বের হওয়ার সবকটা রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে আর আমাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ছিল। অনেকে মারা যায়, যাদের মধ্যে আমার কর্মীরাও ছিলেন।

“প্রথমে ওরা মাঝখান থেকে গুলি করতে শুরু করে। এরপর আমাদের পাশ থেকে এবং পেছন থেকেও গুলি আসতে শুরু করে। আমরা আড়াল নেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু গুলি থেকে রক্ষা পাওয়ার কোনো উপায় ছিল না। বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে আমার স্বামী কো অংও রাস্তায় ছিল।”

স্যাটেলাইট ও অন্যান্য ছবি ব্যবহার করে মিয়ানমারে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা যাচাই করে মিয়ানমার উইটনেস নামের একটি সংস্থা। তাদের ধারণা, ওই দিন হ্লায়িং থারিয়ারে ৮০ জন নিহত হয়ে থাকতে পারেন। তাদের ভাষায়, নিরাপত্তা বাহিনী সেদিন নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালায়।

ওই দিনের একটি ভিডিওতে দেখা যায় একটি সেতুতে অবস্থান নেওয়া পুলিশ সদস্যরা হ্লায়িং থারিয়ারের দিকে তাকিয়ে আছে, নিচে থাকা মানুষজনের ওপর খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে গুলি চালাচ্ছে।

তারা মোয়ের বাড়িতে তল্লাশি চালানোর পরই মোয়ে বুঝতে পারেন যে ইয়াংগনে তার এবং তার পরিবারের আর থাকা সম্ভব না।

বিবিসি লিখেছে, মোয়ের মত প্রথম মাসের প্রতিবাদ সমাবেশে অংশ নেওয়াদের অনেকেই পালিয়ে যেতে শুরু করেন, কয়েকজন সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে একটি মরিয়া, অসম, সশস্ত্র লড়াইয়ে যোগ দেন।

‘পিছিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই’

অভ্যুত্থানের দিন থেকেই অং সান সু চিকে চোখের আড়াল করে ফেলেছে সামরিক জান্তা, বেশি কিছু অভিযোগ এনে বিচার সাজানো হয়েছে তার জন্য।

গত এপ্রিলে তার দলের এমপি এবং কর্মীরা একটি ছায়া জাতীয় ঐক্যের সরকার (এনইউজি) গঠন করে, যা সামরিক জান্তার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনকে ঠেকানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। বিভিন্ন আঞ্চলিক ও জাতিগত গোষ্ঠীর সঙ্গে মিলে জান্তাবিরোধী নেতৃত্বের পরিসর বড় করে চলেছে তারা।

কিন্তু এর সদস্যরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকায় এবং সামরিক বাহিনীর কাছ থেকে পালিয়ে বেড়ানোয়, মিয়ানমারজুড়ে জান্তাবিরোধী সশস্ত্র প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোর ওপর এনইউজির প্রভাব সীমিত।

স্থানীয় এই আধাসামরিক গোষ্ঠীগুলো নিজেদের ‘পিপলস ডিফেন্স ফোর্স’ বা পিডিএফ বলে পরিচয় দিচ্ছে, ছিনিয়ে নেওয়া বা নিজেদের বানানো বন্দুক ও বোমা ব্যবহার করে সামরিক কনভয়ের ওপর হামলা চালাচ্ছে এবং জান্তার কর্মকর্তাদের পেলে হত্যা করছে।

তারা এখন আর শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ নিয়ে খুব একটা আলোচনা করে না। তাদের কেউ কেউ সু চির একনায়কসুলভ নেতৃত্ব, এবং বিগত দিনে অতি ক্ষমতাশালী সামরিক বাহিনীর সঙ্গে থেকে দেশ চালানোর নীতির কট্টর সমালোচক। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, আগের কোনো অবস্থানে আবার ফিরে যাওয়া এখন আর তাদের পক্ষে সম্ভব না।

Back to top button