অফবিট

করোনা মহামারি যাদের জন্য আশীর্বাদ, ফিরিয়েছে ভাগ্য হয়েছে অর্থ লাভ

করোনাভাইরাসের প্রকোপ একদিকে যখন বিশ্বজুড়ে সর্বনাশ ঘটিয়ে দিয়েছে মানুষের জীবনযাত্রার নিরাপত্তা ও অর্থনীতির, তখন এই মহামারি যেন পৌষ মাস হয়ে এসেছে কোভিড-১৯ টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য।

পুঁজিবাদের মূল কথাই হচ্ছে মুনাফা বা লাভ। মারি-মড়ক-যুদ্ধ থেকেও পুঁজিবাদ মুনাফাই পেতে চায়। আর মহামারির সঙ্গে পুঁজিবাদের নাড়ির যোগ তার জন্ম থেকেই। মহামারির হাত ধরেই পুঁজিবাদের জন্ম হয়েছে বলেও অনেকে মত প্রকাশ করেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ইউরোপ বারবার মহামারির আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়েছে। চতুর্দশ শতকের আলোচিত মহামারি ‘গ্রেট প্লেগ’ বা ‘ব্ল্যাক ডেথ’, তাতে ইংল্যান্ডের জনসংখ্যার তিন ভাগের এক ভাগ মারা যায়। আর সেই বিভীষিকার ক্ষণেই সেখানে পয়দা হয় পুঁজিবাদ। এত লোক মারা যাওয়ায় সেখানে একদিকে সামন্তপ্রভুদের ভূমিদাসের সংখ্যা কমে যায়, অনেক শ্রমজীবী ‘মুক্ত’ হয়ে এদিক-ওদিক চলে যায়, আর কাজের মানুষ কম মেলায় মজুরিও কিছুটা বেড়ে গেল। অন্যদিকে অনেক জোতদার মারা যাওয়ায় প্রচুর জমি খালি পড়ে থাকে। তখন এগিয়ে আসে যাদের হাতে টাকা ছিল তারা এবং বড় বড় জমি নিয়ে, বেশি বেশি মজুরি দিয়ে অনেক মজুর নিয়োগ করে কৃষিতে পুঁজিবাদের বীজ বপন করে। শুধু তা-ই নয়, এ সময় থেকে বড় বড় সব ‘কোম্পানি’ও তৈরি হয়, যে কোম্পানি বা করপোরেট সংস্থাগুলো পরবর্তীকালে পুঁজিবাদকে দুনিয়াময় ছড়িয়ে দিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

আবার মারাত্মক প্লেগ এসেছিল সতেরো-আঠারো শতকে। তখন পুঁজিবাদী কৃষিব্যবস্থা ছারখার হয়ে যাওয়ার ফায়দা তোলে কারখানা-মালিকেরা। নতুন নতুন আবিষ্কার হওয়া যন্ত্রপাতির সাহায্যে কম শ্রমিক দিয়ে বেশি উৎপাদনের কায়দা তত দিনে তাদের আয়ত্তে এসে গেছে। আর আসতে শুরু করেছে সস্তায় কলোনির কাঁচামাল। পুঁজিবাদ এবার মড়কের কাঁধে চড়ে সাম্রাজ্যবাদী হয়ে ওঠে।

সেই সময় মড়ক ছড়ায় মূলত উপনিবেশ বা কলোনিগুলোয়। একদিকে পাশ্চাত্যের চিকিৎসাবিজ্ঞান যেমন উপনিবেশের প্রজাদের গিনিপিগ বানিয়ে রোগারোগ্য বিষয়ে অগাধ জ্ঞান আহরণ করে, অন্যদিকে সেই জ্ঞানকে ক্ষমতার উৎস হিসেবে ব্যবহার করে সেই প্রজাদের ওপরে নিজেদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও শারীরিক আধিপত্যকে আরও পাকাপোক্ত করেন সাম্রাজ্যবাদী শাসকেরা। মাঝখানে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার উত্থান। পূর্ব ইউরোপের কিছু দেশে ভিন্ন প্রক্রিয়ার শাসনব্যবস্থা চালু। পুঁজিবাদের অবাধ প্রবাহে খানিকটা প্রতিরোধ!

কিন্তু বাস্তব থেকে শিক্ষা নিয়ে অল্প দিনের মধ্যেই পুঁজিবাদ আরও পরিণত হয়ে ওঠে। পুরোনো ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের বোঝাকে ঝেড়ে ফেলে বিশ্বজোড়া করপোরেট-বাণিজ্য ব্যবস্থার মাধ্যমে নয়া উপনিবেশবাদ গড়ে ওঠে। এই নতুন প্রক্রিয়ায় দুনিয়াদারি চালাতে গিয়ে উদ্ভাবন করা হলো ‘উন্নয়ন’ আর ‘বিশ্বায়ন’-এর নতুন দর্শন, যার মায়ায় বশ হলো জগতের মানুষ। এদিকে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থারও বিপর্যয় ঘটে গেছে। পালটা কোনো দর্শন নেই, যে স্পর্ধার সঙ্গে রুখে দাঁড়াতে পারে। চীন তত দিনে জেনে গেছে, ‘ইট ইজ গুড টু বি রিচ’ বড়লোক হওয়া দোষের নয়। কিউবার মতো দু-একটা ছোটখাটো দেশকে বাদ দিলে ঘাড়-ত্যাড়ামি করার মতো আর কেউ নেই। এর মধ্যে বজ্রাঘাতের মতো এল আরেক মহামারি এইডস। প্রথমদিকে একটু হকচকিয়ে গেলেও অসাধারণ দক্ষতার সঙ্গে তাকেও নিজের স্বার্থে ব্যবহার করল নয়া ঔপনিবেশিক পুঁজিবাদ। তার অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের মায়া-কাজল এঁকে চলল এইডস নিয়ন্ত্রণের বিশ্বায়ন। এই নতুন দর্শন অনুসারে আগেকার ‘কল্যাণমূলক পুঁজিবাদ’ অচল হয়ে গেল। রোগ নিরাময়, মারি-মুক্তি, কোনো কিছুই আর ‘জনসেবা’র ঘোমটা পরে রইল না। সরাসরি সুর ধরল, মাল ছাড়ো, রোগ সারাও। মড়কের থেকে মুনাফা আদায় করল পুঁজিবাদ।

পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের কোনো দায় নেই মড়ক দমনের, কোনো চরম ব্যবস্থা নেওয়ার আগে তার ছোট-বড় প্রভাব সম্পর্কে জনসাধারণের সঙ্গে তথ্য আদান-প্রদান করার, কোনো সংলাপ তৈরি করার। সবটাই একতরফা। উল্টো দিকে, জনগণের ‘দেশপ্রেমের’ দায় তার সব নিদান বিনা প্রশ্নে মেনে নেওয়ার। যেমন মেনে নিতে হয়েছে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের’ নামে তার সব দৌরাত্ম্য, তেমনি মানতে হবে ‘করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধের’ নামে তার একচ্ছত্র আধিপত্য। কারণ, পুঁজিবাদ সাপ হয়ে কাটে, আবার ওঝা হয়ে ঝাড়ে। সে নিজেই রোগ বয়ে আনলেও তা সারানোর কায়দাও সে-ই একমাত্র আবিষ্কার করতে পারে। আর মারির বিষকে ব্যবহার করতে পারে তার নিজের দুরারোগ্য ক্ষতের ওপরেও মলম লাগাতে। এবার, এই করোনাকালে সে তাই করতে চলেছে।

অন্তত দশ বছর ধরে পুঁজিবাদ একটা গাড্ডায় পড়ে রয়েছে। সেই গাড্ডা থেকে এবার সে উঠে আসার প্রাণপণ চেষ্টা করছে করোনার কাঁধে চড়ে। গল্পটা সবাই জানে। তবু আর একবার ঝালিয়ে নেওয়া যাক। ২০০৮-০৯ সালে সারা পৃথিবীতে পুঁজিবাদের সংকট নেমে এসেছিল। আমেরিকা, ইংল্যান্ডসহ নানা দেশে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যর্থ হয়ে পড়েছিল, বহু লোকের চাকরি গিয়েছিল, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ আর সরকারগুলোকে বাজারে বিস্তর টাকা ঢেলে মন্দা সামাল দিতে হয়েছিল। তার পর থেকেই শোনা যাচ্ছিল, পুঁজিবাদী অর্থনীতিকে এবার ঢেলে সাজাতে হবে। না হলে সেবার যে দেশগুলোর গায়ে তেমন আঁচ লাগেনি, যেমন ভারত, ব্রাজিল ও চীন, আগামী সংকটে তারাও ঝলসে যেতে পারে। সেই আগামী সংকটও প্রায় ঘাড়ের ওপর চলে এসেছিল। আমেরিকার সঙ্গে চীনের শুল্কযুদ্ধে কারোরই হার-জিত কিছু বলা যাচ্ছিল না। এশিয়ার অর্থনীতির হাল ডুবুডুবু। ইউরোপের অর্থনীতি নিশ্চল, তার অগ্রগতির ইঞ্জিন জার্মানির শিল্পক্ষেত্রে ভাটা লেগেছে। জাপানের অর্থনীতিও ক্রমেই কুঁকড়ে ছোট হয়ে আসছিল।

এখন এই সবকিছুর দায় কেয়ার অব করোনাভাইরাস। করোনা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ত্রাতা হয়ে এসেছে যেন। হ্যাঁ, ইউরোপ-আমেরিকায়ও মানুষ মরেছে। মানুষ তো মরবেই, এর মধ্যে কিছু রথী-মহারথীও থাকবে, কিন্তু তাতে ক্ষতি কী, ব্যবস্থাটা তো বাঁচবে! এই মড়কের কালেও পুঁজিবাদ তার ব্যবসা ঠিকই চালিয়ে যাচ্ছে। পুঁজিবাদী দুনিয়ার দখলে থাকা প্রযুক্তি আর অনলাইন ব্যবসা ফুলেফেঁপে উঠছে।

করোনাভাইরাসের প্রকোপ একদিকে যখন বিশ্বজুড়ে সর্বনাশ ঘটিয়ে দিয়েছে মানুষের জীবনযাত্রার নিরাপত্তা ও অর্থনীতির, তখন এই মহামারি যেন পৌষ মাস হয়ে এসেছে কোভিড-১৯ টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য। যেসব দেশ ও কোম্পানি টিকা তৈরি করেছে, তারা সবাই অর্থনৈতিকভাবে দাঁও মারছে।

বিশ্বজুড়ে ইতিমধ্যে যে কয়টি কোম্পানির কোভিড টিকা বেশি বিক্রি হয়েছে, সেগুলো হলো–অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিশিল্ড, ফাইজার-বায়োএনটেকের কমিরনাটি, মডার্নার টিকা। এর পরেই রয়েছে চীনের সিনোফার্মের টিকা বিবিআইবিপি-কোরভি, রাশিয়ার তৈরি স্পুটনিক-ভি ও জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকা জানসেন। কেবল ফাইজার-বায়োএনটেক ও মডার্না টিকা বিক্রি করে সম্মিলিতভাবে প্রতি মিনিটে ৬৫ হাজার মার্কিন ডলার মুনাফা করছে,

গত বছর পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধনীদের তালিকায় যাঁরা নাম লিখিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা। করোনার টিকার বদৌলতেই তাঁরা এটা অর্জন করেছেন। ধনীদের তালিকায় যাঁরা যুক্ত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে আছেন মডার্নার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) স্টেফান ব্যানচেল ও বায়োএনটেকের সিইও উগুর সাহিন। দুজনের সম্পদ প্রায় ৪ বিলিয়ন বা ৪০০ কোটি ডলারের মতো। এ ছাড়া কাগজে-কলমে চীনের ক্যানসিনো বায়োলজিকসের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা এবং মডার্নার শুরুর দিকের বিনিয়োগকারীরাও ধনীদের তালিকায় যুক্ত হয়েছেন।

ফার্মাসিউটিক্যালস সংস্থাগুলোর কাছে করোনাভাইরাস হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো। এই বিশ্বব্যাপী সংকট তাদের বিক্রয় ও মুনাফা বিপুল বাড়িয়ে তোলার মোক্ষম সুযোগ। খতিয়ে দেখলে বোঝা যাবে যে বড় করপোরেট ফার্মা কোম্পানির ছোঁয়াচে রোগের প্রতিরোধ নিয়ে গবেষণায় কোনো আগ্রহ নেই। ছয়ের দশক থেকেই করোনাভাইরাস গোত্রের সার্স বা মার্সের সন্ধান পাওয়া গেলেও এর প্রতিষেধক উদ্ভাবন করা যায়নি কেন? আসলে তাদের পছন্দ রোগ নিরাময়ের জন্য উদ্ভাবনে পয়সা ঢালা। আমরা যত বেশি অসুস্থ হব, তারা তত বেশি মুনাফা করবে। আমরা সুস্থ থাকলে তারা যে অসুস্থতা বোধ করবে–এ কথা বলাই বাহুল্য!

কাজেই করোনায় বড়লোকেরা আরও বড়লোক হচ্ছে, ধনবৈষম্য বাড়ছে, বড়লোকেরাই কেবল সরকারি প্রণোদনা পাচ্ছে; কিন্তু গরিবেরা তেমন কিছু পাচ্ছে না। কাজ হারাচ্ছে, চরম দুর্দশায় নিপতিত হচ্ছেন–এসব বলে মাতম করে কোনো লাভ নেই। দেশে এবং বিশ্বে পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটা বদলের উদ্যোগ না নিলে এসব চলতেই থাকবে।

Back to top button