বিশেষ: অনলাইনে বইবিক্রেতা থেকে আজ ১০০ কোটির মালিক, জেনেনিন তরুনের সাফল্যের কাহিনী
বয়স মাত্র ৪০। অথচ এই বয়সেই ভারতের মতো একটি বিশাল দেশের কনিষ্ঠতম বিলিয়নিয়ার হিসেবে জায়গা করে নিয়েছেন তিনি। ছোট্ট ফ্ল্যাট বাসাকে অফিস বানিয়ে অনলাইনে বই বিক্রি দিয়ে যে ব্যবসা শুরু করেছিলেন, তা আজ ডালপালা ছড়িয়ে পরিণত হয়েছে সুবিশাল মহীরুহে। দেখতে দেখতে তার গড়া প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছে নিজেই একটি ব্র্যান্ড, অর্জন করেছে কোটি কোটি মানুষের আস্থা।
বলা হচ্ছে ভারতীয় ব্যবসায়ী বিনি বানসাল ও তার প্রতিষ্ঠান ফ্লিপকার্টের কথা। প্রতিষ্ঠাতার নাম না জানলেও ফ্লিপকার্টের না শোনেননি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার! অনলাইনে কেনাবেচার এই প্ল্যাটফর্মটিকে অনেকেই ‘ভারতীয় অ্যামাজন’ বলেও উল্লেখ করে থাকেন। আশ্চর্যজনকভাবে ফ্লিপকার্টের দুই সহ-প্রতিষ্ঠাতা বিনি বানসাল এবং শচীন বানসাল সেই অ্যামাজনেরই সাবেক কর্মী!
তবে আজকের গল্পে মূল দৃষ্টি বিনির দিকে। প্রভাবশালী মার্কিন সাময়িকী ফোর্বসের তথ্য বলছে, এই মুহূর্তে ভারতের কনিষ্ঠতম বিলিয়নিয়ারের নাম বিনি বানসাল। ৩৯ বছর বয়সী এ ব্যবসায়ীর সম্পত্তির পরিমাণ ১ দশমিক ৪০ বিলিয়ন বা ১৪০ কোটি মার্কিন ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৪ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা প্রায়)।
অনেকেই ভাবতে পারেন, বিনি বানসাল ও শচীন বানসাল হয়তো দুই ভাই। কিন্তু সেটি সত্য নয়। তারা ভাই হওয়া তো দূরের কথা, দূর সম্পর্কের আত্মীয়ও নন। কেবল সাবেক সহকর্মী মাত্র।
পড়াশোনা ও চাকরি
বিনি বানসালের জন্ম ১৯৮৩ সালে ভারতের চণ্ডীগড়ে। দিল্লির আইআইটি (ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি) থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে বি-টেক ডিগ্রি নিয়ে যোগ দেন সারনফ করপোরেশন নামে একটি সংস্থায়। শোনা যায়, বিনি দু’বার গুগলে চাকরির জন্য চেষ্টা করেছিলেন এবং দু’বারই প্রত্যাখ্যাত হন।
এরপর ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে অ্যামাজনে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যোগ দেন তিনি। প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানটিতে এর আগের বছর যোগ দিয়েছিলেন শচীন বানসাল। তিনিই মূলত বিনির চাকরির জন্য সুপারিশ করেছিলেন। দিল্লি আইআইটি’তে ভিন্ন শিক্ষাবর্ষের ছাত্র থাকাকালে ঘটনাক্রমে একটি ল্যাবে পরিচয় হয়েছিল তাদের। স্নাতক ডিগ্রি লাভ করার পর কর্মসূত্রে দুজনেই ব্যাঙ্গালোরে পাড়ি জমান। সেখানে শচীন যোগ দেন টেকস্প্যান নামে একটি প্রতিষ্ঠানে, আর বিনি যান সারনফে।
আবার অ্যামাজনে ফেরা যাক। এরকম একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরিরত দুই যুবক (বিনি ও শচীন) ঠিক করলেন, চাকরি ছেড়ে নিজেরাই একটি কোম্পানি খুলবেন। অনেকের কাছেই কাজটা বোকামি মনে হতে পারে, কিন্তু নতুন কিছু করতে গেলে ঝুঁকি তো নিতেই হবে!
অ্যামাজনে যোগ দেওয়ার নয় মাস পরেই চাকরি ছেড়ে দেন বিনি। তার পথ ধরেন শচীনও। এরপর বড় ঝুঁকি নিয়েই ই-কমার্সের মতো একটি অনিশ্চিত ব্যবসার দুনিয়ায় পা রাখেন তারা।
ফ্লিপকার্টের যাত্রা শুরু
২০০৭ সালের অক্টোবরে মাত্র পাঁচ লাখ টাকা মূলধন নিয়ে যাত্রা শুরু করে ফ্লিপকার্ট। সেসময় প্রতিষ্ঠানটির নেতা ও পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন শচীন, আর অপারেশন্স চিফ হিসেবে দায়িত্ব নেন বিনি।
শুরুতে অনলাইনে কেবল বই বিক্রি করতো ফ্লিপকার্ট। কাজের পরিধি ছিল ব্যাঙ্গালোরের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কোনো অর্ডার পেলে নিজেরাই বই প্যাকেট করে স্কুটি চালিয়ে ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে দিতেন বিনি ও শচীন। কিন্তু শুনে যতটা সহজ মনে হচ্ছে, বিষয়টা মোটেও তেমন ছিল না।
একের পর এক বাধা
শুরুর দিকে বিক্রেতারা অনলাইনের মতো একটি অনিশ্চিত প্ল্যাটফর্মে বই বিক্রি করতে রাজি ছিলেন না। সেসময় মানুষ না দেখে না ছুঁয়ে আগে থেকে পেমেন্ট করে জিনিস কেনার ব্যাপারে ভীষণ সন্দেহবাতিক ছিল। ফলে তাদের ওপর বিশ্বাস করে কোনো বিক্রেতা এগিয়ে আসতে চাননি। কিন্তু বিনি-শচীনও হার মানার পাত্র নন। অনেক কষ্টে কয়েকজন বই বিক্রেতাকে রাজি করিয়ে ২০০৭ সালের অক্টোবরে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে তাদের ওয়েবসাইট।
ওই মাসের শেষের দিকে ভি ভি কে চন্দ্র নাম এক যুবকের কাছ থেকে প্রথম বইয়ের অর্ডার পায় ফ্লিপকার্ট। বিনি-শচীনের কাছে এই মুহূর্তটা ছিল বিশ্বজয়ের মতো ব্যাপার। কিন্তু তারা খেয়াল করেন, যে বইয়ের অর্ডার এসেছে তা তাদের নির্ধারিত কোনো বিক্রেতার কাছে পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু গ্রাহকের বিশ্বাসকে টলতে দিলে তো চলবে না। তাই গোটা ব্যাঙ্গালোর তন্নতন্ন করে খুঁজে সেই বই জোগাড় করা হয় এবং গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়।
এভাবে দুই যুবকের অক্লান্ত পরিশ্রমে ভারতে এমন একটি ব্যবসা দাঁড়িয়ে যায়, যা অনলাইন কেনাকাটায় আমূল পরিবর্তন এনে দেয়। চালু হওয়ার ছয় মাসের মধ্যেই লাভের মুখ দেখে ফ্লিপকার্ট। পাঁচ লাখ টাকা নিয়ে শুরু করে মাত্র দু’বছরের মাথায় চার কোটি টাকার বই বিক্রি করে ফেলেন তারা, যা ছিল অভাবনীয়।
ধীরে ধীরে বইপ্রেমীদের কাছে ফ্লিপকার্ট ওঠে একটি বিশ্বাসের জায়গা। তার ফলও মেলে হাতেনাতে। বিনিয়োগকারীদের নজরে পড়তে থাকে প্রতিষ্ঠানটি। ২০০৯ এ অ্যাকসেল নামে একটি প্রতিষ্ঠান ১০ লাখ ডলার বিনিয়োগ করতে রাজি হয়। এরপর ২০১০ সালে এক কোটি ডলার বিনিয়োগ করে টাইগার গ্লোবাল। নতুন অংশীদার ও আরও বেশি পুঁজি নিয়ে ফ্লিপকার্ট তাদের ওয়েবসাইটে ইলেক্ট্রনিকস বিভাগ চালু করে। বইয়ের সঙ্গে নতুন সংযোজন হয় মোবাইল। কিন্তু এবারও বাধা। মানুষ না ছুঁয়ে মোবাইলের মতো দামি জিনিস অনলাইনে কেনার ভরসা পেলো না।
গ্রাহকদের এই দ্বিধা বুঝতে পেরে ভারতে প্রথমবারের মতো ‘ক্যাশ অন ডেলিভারি’ ব্যবস্থা চালু করে ফ্লিপকার্ট। জিনিস হাতে পেয়ে টাকা দিতে মানুষ অনেক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করলো। এরপর ফ্লিপকার্ট বাজারে নিয়ে এলো সহজ রিটার্ন ও রিপ্লেসমেন্ট পলিসি। ক্রেতাদের সন্তুষ্ট করতে গিয়ে প্রাথমিকভাবে লাভ কিছুটা কমলেও এই তিনটি পলিসির কারণে তাদের বিক্রি কয়েকগুণ বেড়ে যায়।
২০১১ সালে ফ্লিপকার্টের মুনাফা বেড়ে দাঁড়ায় ৭৫ কোটি টাকা। তখনো ভারতে অনলাইনে কেনাকাটা অতটা জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। তবু ২৪ ঘণ্টার কাস্টমার সার্ভিস চালু করে ব্র্যান্ডের প্রতি মানুষের আস্থা ও ভালোবাসা দুটোই অর্জন করতে সক্ষম হয় বিনি-শচীনের ফ্লিপকার্ট।
প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা
পাঁচ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রম আর ধৈর্যের ফলে ২০১২ সালের দিকে ভারতীয় বাজারে একচেটিয়া আধিপত্য তৈরি করে ফ্লিপকার্ট। কিন্তু ২০১৩ সালে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ভারতীয় বাজারে ঢোকে অ্যামাজন। প্রতিযোগিতা থাকলে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ আসবে, এটাই স্বাভাবিক।
বাজারে টিকে থাকতে ওয়েবসাইটে নতুন নতুন বিভাগ সংযোজন করতে থাকে ফ্লিপকার্ট। প্রতিষ্ঠানটির তথ্যমতে, বর্তমানে ইলেক্ট্রনিকস, দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিসপত্র, ফ্যাশন, গ্রোসারিসহ অন্তত ৮০টি বিভাগে আট কোটির বেশি জিনিসপত্র বিক্রি হয় তাদের ওয়েবসাইটে।
শেয়ার বিক্রি
২০১৮ সালে ১ হাজার ৬০০ কোটি ডলারে ফ্লিপকার্টের ৭৭ শতাংশ শেয়ার কিনে নেয় মার্কিন রিটেইলার কোম্পানি ওয়ালমার্ট। এটি ছিল ইন্টারনেটনির্ভর কোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য সেসময় বৃহত্তম বিক্রয় চুক্তি। পরে নিজের শেয়ার বিক্রি করে ফ্লিপকার্ট ত্যাগ করেন শচীন। বিনিও মাত্র দুই শতাংশ রেখে বাকি সব শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন। তবে প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদে একটি আসন রয়েছে তার।
অর্জন
ফোর্বসের হিসাবে, ২০১৫ সালে ১৩০ কোটি ডলারের সম্পদ নিয়ে ভারতের ৮৬তম ধনী হওয়ার গৌরব অর্জন করেন বিনি ও শচীন।
২০১৬ সালে টাইম ম্যাগাজিনের ১০০ প্রভাবশালীর তালিকায় জায়গা করে নেন এ দুই উদ্যোক্তা।
২০১৭ সালে ইন্ডিয়া টুডে’র নজরে শীর্ষ ৫০ প্রভাবশালীর তালিকায় ২৬তম হয়েছিলেন বিনি ও শচীন।
২০২২ সালে এই প্রতিবেদন লেখার সময় ফোর্বসের রিয়েল টাইম বিলিয়নিয়ার ইনডেক্সে ভারতের কনিষ্ঠতম এবং বিশ্বের ১৯৯২তম ধনী ব্যক্তি বিনি বানসাল।
সূত্র: ফোর্বস, টাইমস অব ইন্ডিয়া, স্টারস আনফোল্ডেড ডটকম, ম্যান্সওয়ার্ল্ড ইন্ডিয়া