অফবিট

দীঘা টু এভারেস্ট বেস ক্যাম্প! সাইকেল চালিয়ে করেছেন সফর, চেনেন বাঙালির মাউন্টেন ম্যানকে?

সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫,৩৬৪ মিটার বা ১৭,৫৯৮ ফুট উঁচুতে অবস্থিত এক তুষারময় বেস ক্যাম্প—এভারেস্ট বেস ক্যাম্প। এখান থেকেই শুরু হয় এভারেস্ট আরোহণের যাত্রা। সাধারণ মানুষ সচরাচর এই বেস ক্যাম্পে পৌঁছানোর সাহস দেখায় না। বাইকে করে যাওয়া একটা দুরূহ কাজ, হেঁটে যাওয়া তার চেয়েও কঠিন, আর সবচেয়ে কঠিন হলো সেই পথে সাইকেল চালানো।

একবার কল্পনা করুন—এবড়োখেবড়ো পথ, কোথাও এমন চড়াই যে হেঁটে ওঠাই দায়। কোথাও রাস্তার মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে নদী। সেই পথে কখনো সাইকেল চালিয়ে, কখনো তা কাঁধে তুলে এগিয়ে চলেছেন। সঙ্গে রয়েছে জামাকাপড় আর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ভার। এই অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখিয়েছেন বাংলার ছেলে জ্যোতিষ্ক বিশ্বাস।

নদীয়ার জ্যোতিষ্ক বড় হয়েছেন পাহাড়ের কোলে। তাই শান্ত, শীতল পরিবেশ তাঁকে সবসময় টানে। পড়াশোনার জন্য কলকাতায় এলেও পাহাড়ের প্রতি মায়া কাটাতে পারেননি। সুযোগ পেলেই ছুটে যেতেন অ্যাডভেঞ্চারে। এখন সেই নেশাকেই পেশা করে এগিয়ে চলেছেন। সম্প্রতি শুধু সাইকেলে চড়েই সমুদ্র থেকে এভারেস্ট পর্যন্ত যাত্রা সম্পন্ন করেছেন তিনি।

গত ৯ ফেব্রুয়ারি বঙ্গোপসাগরের তীরে বাঙালির প্রিয় দীঘা থেকে শুরু হয় তাঁর যাত্রা। কলকাতা, মালদহ, শিলিগুড়ি হয়ে নেপালের পথ ধরে পৌঁছে যান এভারেস্ট বেস ক্যাম্পে—শুধুই সাইকেলে। প্রয়োজনে সাইকেল কাঁধে তুলে নিয়েও এগিয়েছেন গন্তব্যের দিকে।

সুটকে পর্যন্ত চালিয়েছেন সাইকেল। তারপর শেষ ৬০ কিলোমিটারের মধ্যে ৪০ কিলোমিটার সাইকেল চালাতে পেরেছেন। চড়াই-উতরাইয়ের রাস্তায় বাকি ২০ কিলোমিটার হেঁটে যেতে হয়েছে, সাইকেল কাঁধে নিয়েই।

জ্যোতিষ্ক বলেন, হঠাৎ করে সাইকেল নিয়ে এভাবে বেরিয়ে পড়া যায় না। এর জন্য দরকার দীর্ঘদিনের প্রস্তুতি। তিনি জানান, “৭ বছর ধরে এই অ্যাডভেঞ্চারের পরিকল্পনা করছিলাম। সাইকেল সম্পর্কে জানাশোনা না থাকলে এটা সম্ভব নয়। শুধু ইচ্ছা দিয়ে হয় না।”

১০ মার্চ গন্তব্যে পৌঁছান জ্যোতিষ্ক। মাত্র ২৫ দিনে এই যাত্রা শেষ করেন। তিনি বলেন, পথে লোগুচে নামে একটা জায়গা আছে, যার উচ্চতা প্রায় ৫,০০০ মিটার। সাধারণত একদিনে পাহাড়ে ৫০০ মিটারের বেশি না ওঠার কথা, কিন্তু সেদিন ১,৪০০ মিটার উঠে সমস্যায় পড়েছিলাম। রাতে নীচে নামতে হয়েছিল। তবু হাল ছাড়িনি। পরদিন আবার শুরু করি।” তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, “আমি কিছুকেই সমস্যা মনে করি না। ওগুলো আমার কাছে অভিজ্ঞতা।”

জ্যোতিষ্ক জানান, কলকাতায় শীতের প্রকোপ কমলেও উত্তরে ঠান্ডা বেড়েছে। হিমবাহের মধ্যে সাইকেল চালানো সহজ ছিল না। কখনো চালিয়ে, কখনো ঠেলে, কখনো কাঁধে করে এগোতে হয়েছে। দিনে তাপমাত্রা থাকত মাইনাস ৪-৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, রাতে নেমে যেত মাইনাস ২৫ ডিগ্রিতে। সঙ্গে সূর্যের ইউভি রশ্মির প্রভাবে ডিহাইড্রেশনের ঝুঁকি বাড়ত।

তিনি বলেন, “অরুণাচল প্রদেশ আর উত্তরবঙ্গের মাথাভাঙায় বড় হয়েছি। তাই কলকাতায় এসে পাহাড়কে মিস করতাম।” পাহাড়ের পাশাপাশি জ্যোতিষ্কের ভালোবাসা বিভিন্ন অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসের প্রতি—ট্রেল রানিং, সাইকেলিং, ম্যারাথন, মাউন্টেনিয়ারিং।

জ্যোতিষ্কের অভিজ্ঞতার ঝুলিতে আরও অনেক কিছু রয়েছে। কর্ণাটকের চিকমাগালুরে কফির স্বাদ আর পাহাড়ের সৌন্দর্যের অভিজ্ঞতা অতুলনীয়। সেখানে ৪,০০০ কিলোমিটারের ট্রেক মাত্র ১৫ ঘণ্টায় শেষ করেছেন। ২০২৩ সালে এভারেস্ট বেস ক্যাম্পে পৌঁছেছিলেন। মাউন্টেনিয়ার হিসেবেও কাজ করেছেন। ২০২০ সালে ৪৮ দিনে সাইকেলে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী যাত্রা সম্পন্ন করেন।

তিনি গোটা হিমালয় পর্বতমালাও প্রদক্ষিণ করেছেন। ৬ মাসে পশ্চিম থেকে পূর্বে ৭,০০০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করেন ট্রান্স হিমালয় যাত্রায়।

অ্যাডভেঞ্চারের প্রতি ভালোবাসা আর পৃথিবীকে জানার তাগিদে এগিয়ে চলেছেন জ্যোতিষ্ক। “কেন এই ভাবনা?”—এই প্রশ্নে তিনি মুচকি হেসে বলেন, “কেন নয়?” তারপর পাহাড়প্রেমী হিসেবে বলেন, “পাহাড় পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন ড্রাগ। একবার কেউ এর নেশায় পড়লে, জীবনে পাহাড় ছাড়া আর কিছু থাকে না।”

Back to top button