বিনোদন

স্বর্ণযুগের এক স্থপতি হলেন মহানায়ক উত্তম কুমার, হাসিমুখে বিশ্বজয় করেছিলেন, রইলো কিছু অজানা কাহিনী

বাংলা সিনেমার জগতে একজন অসাধারণ শিল্পী ও অভিনেতা ছিলেন মহানায়ক উত্তম কুমার। যিনি এমন একজন কিংবদন্তি যার হাত ধরে বাংলা টলিউড ইন্ডাস্ট্রিতে এসেছে একের পর এক নতুন চমক। তবে উত্তম কুমারকে মহানায়ক উপাধি তো এমনি দেওয়া হয়নি। তার পিছনে ছিল অভিনেতার অক্লান্ত পরিশ্রম ও সংগ্রাম। যার জন্যই তিনি মহানায়ক। অভিনয়কে মন থেকে ভালোবেসে নিজের সবটুকু দিয়ে করেছিলেন অভিনয়। দূর থেকে যতটা দেখতে মনে হয় সহজ ঠিক ততটাই তাকে অতিক্রম করতে হয়েছে কঠিন পরিস্থিতি। এর আগে দেখা গিয়েছিল বর্তমানে অন্যতম অভিনেতা যীশু সেনগুপ্তের কঠোর জীবন সংগ্রাম। এবার উঠে এলো মহানায়কের কিছু অজানা জীবন কাহিনী।

১৯২৬ সালের ৩ রা সেপ্টেম্বর, তৎকালীন উত্তর কলকাতার একটি মধ‍্যবিত্ত পরিবারে কিছুক্ষণ আগেই জন্ম হয়েছে একটি শিশুর।মা তখনও আঁতুড়ঘরে। এর মধ্যেই শিশুর দাদু অর্থাৎ মায়ের বাবা শিশুটির নাম ঠিক করে ফেলেছেন, উত্তম। মায়ের এই নাম পছন্দ হয়নি সেই সময়। তার মা একটু আধুনিক নাম রাখতে চেয়েছিলেন। তাই নবজাতকের নামকরণ হল অরুণ। এর মধ্যেই বাড়িতে আগমন হল পারিবারিক গুরুদেবের। তিনি এক যোগীপুরুষ।অরুণকে দেখে গুরুদেব বললেন, এই ছেলের একদিন ভারতজোড়া খ্যাতি হবে। আশীর্বাদ করে চলে গেলেন গুরুদেব।ধীরে ধীরে অরুণ বড় হচ্ছে। এদিকে ছেলের খুব অভিনয়ের শখ। পড়াশোনায় মোটেও মন নেই।

 

View this post on Instagram

 

A post shared by Uttam Kumar (@mahanayak_uttam)

অপরদিকে মায়ের শখ যে ছেলে জজ বা ব্যারিস্টার হবে কিন্তু ছেলের মধ্যে সেই ভাবনায় নেই। সারাদিন শুধুই অভিনয় করার ইচ্ছা। তাহলে কি গুরুদেবের আশীর্বাদ মিথ্যা হয়ে যাবে? এদিকে অভাবের সংসার। একটা পাশ দিয়েই অরুণকে ঢুকতে হল কেরানীর চাকরিতে।সেই সঙ্গেই তিনি যোগ দেন নাটকের দলে । খুব পরিশ্রম করতে হচ্ছিল সংসারকে দাঁড় করাতে। অফিস থেকে ফিরেই মায়ের তৈরি পরোটা-আলুপোস্ত খেয়েই তাঁকে ছুটতে হত থিয়েটার করতে। এরকম কঠিন সময়ের মাঝেই তার কাছে এলো সিনেমায় অভিনয়ের সুযোগ। তবে তা খুবই ছোট্ট চরিত্রে। ফিল্মের নাম ‘মায়াডোর’। চরিত্রটি হল বরের। বিয়ে করতে এসে বর মার্ খেয়ে পালাবে। সেই পার্টেই মন দিয়ে অভিনয় করলেন অরুণ। বাড়ির সকলের মনে আনন্দ। এবার তাঁদের অরুণকে দেখা যাবে সিনেমায়।

এরপর তিনি ভাবতেন যে এইরকম পরিশ্রম আর কতদিন তাকে করতে হবে। রাতে শুয়ে অরুণের মনে হতো, এইভাবেই কি তিনি ফুরিয়ে যাবেন? কিন্তু অরুণ হাল ছাড়লেন না। ১৯৪৮ সালে ‘দৃষ্টিদান’ ফিল্মে সুযোগ পেলেন অরুণ।শুরু হল উত্তম হয়ে ওঠার সাধনা। একের পর এক ফিল্ম, একের পর এক চরিত্র। সব চরিত্রেই তিনি সেরা।১৯৫৩ সালে সাড়ে চুয়াত্তর নামক ছবিতে প্রথম হাজির হন। নিজের ফিল্মি নাম দেন উত্তম কুমার।পঞ্চাশের পরের দশকে হারানো সুর, সপ্তপদী, চাওয়া পাওয়ার মতো কয়েকটি ছবি বাণিজ্যিকভাবে সফল হয়েছিল। ১৯৬৬ সালে সত্যজিৎ রায়-এর ‘নায়ক’-এ উত্তম যেন তুলে দিয়েছিলেন নিজের জীবন। সেই সময় মুম্বাই থেকে একের পর এক সিনেমার অফার আসতে শুরু করেছিল কিন্তু কিছু কারণে রাজ কাপুর-এর একের পর এক কালজয়ী ফিল্মের অফার ফিরিয়ে দিলেন উত্তম। একটা সময় টালমাটাল হয়ে উঠেছিল উত্তমের দাম্পত্য জীবনও। উত্তমের সুখ-দুঃখের সাথী, তাঁর সহধর্মিণী গৌরী দেবী স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন উত্তমের সঙ্গে সুপ্রিয়া-র সম্পর্কের কথা শুনে।

একটা সময় উত্তম সুপ্রিয়াকে বিয়ে করার অনুমতি চেয়েছিলেন গৌরীর কাছে। তখন মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়েছিলেন গৌরী। কারণ তিনি জানেন যে উত্তমকে আটকাতে পারবেন না। উত্তম-সুপ্রিয়া মন্দিরে গিয়ে বিয়ে করলেন। ময়রা স্ট্রিটের বাড়িতে রয়ে গেলেন গৌরী। উত্তম ও সুপ্রিয়া নতুন সংসার পাতলেন।কিন্তু এই সময় থেকেই ধস নামতে শুরু করল উত্তমের জীবনে। দুটি সংসার চালাতে তাঁকে মাসে অন্তত চল্লিশ হাজার টাকা রোজগার করতে হত।অভিনেতা উত্তম নিজেই একথা জানান শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়কে। সেই সময় তার শরীরে বাসা বাঁধতে শুরু করে অসুখ। তার উপর মাত্রাতিরিক্ত অ্যালকোহল গ্রহণ উত্তমকে খাদের কিনারায় এনে দাঁড় করিয়েছিল। তার দ্বিতীয় স্ত্রী সুপ্রিয়ার সাথে মতের পার্থক্য দেখা দেয়। সুপ্রিয়াকে ছেড়ে বেরিয়ে আসেন একটা সময়। সেই অবস্থাতেই শুরু করলেন ‘ওগো বধূ সুন্দরী’-র শুটিং। সিঁড়ি থেকে নামার একটি দৃশ্য ছিল।বারবার নেমে আসছেন, কিন্তু পছন্দ হচ্ছে না। পরিচালক উত্তমকে বলছিলেন, শট পারফেক্ট আছে।

সেই সময় তার শরীরটা হঠাৎই খারাপ হয়ে উঠলো। মহানায়কের চোখের সামনে নেমে এলো অন্ধকার। স্টুডিওর রাশিকৃত আলো, সবকিছু কেমন আবছা হয়ে যাচ্ছে কেন? ছুটে আসছেন পরিচালক, সহ অভিনেতা-অভিনেত্রীরা। সুমিত্রা ছুটে এলেন। তাঁর ‘দাদা’ ডাক উত্তমের কানে পৌঁছাচ্ছে কি? অনেক কাজ বাকি রয়ে গেল যে, অনেক কমিটমেন্ট, উঠে দাঁড়াতে হবে! কিন্তু পারলেন না আর উত্তম। অচেতন অবস্থায় বেলভিউ নিয়ে যাওয়া হল। ষোলো ঘন্টা যমে-মানুষে লড়াইয়ের শেষে জিতে গেল অমোঘ মৃত্যু।সেই সময় হার মেনে গেল চিকিৎসকরাও। মাত্র তিপ্পান্ন বছর বয়সে মহানায়কের মৃত্যুসংবাদ ঝড়ের মতো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। উত্তমের মৃত্যুর পর তাঁর বডি ডাবল শেষ করেছিলেন ‘ওগো বধূ সুন্দরী’-র কাজ।এর পরে অভিনেতার যেগুলি ছবিতে অভিনয় করার কথা ছিল সেসময় সেগুলি সিনেমাতেও অভিনয় করেছিলেন অন্য অভিনেতারা। তার মৃত্যু ঘটে গেছে কিন্তু তার প্রতিভার মৃত্যু ঘটেনি। মানুষের মৃত্যু হয় কিন্তু প্রতিভার মৃত্যু হয় না। কিন্তু তার সেই প্রতিভা অতিক্রম করতে কেউ পারেননি।

Back to top button