
স্কুল সার্ভিস কমিশন (SSC)-এর নিয়োগ দুর্নীতি মামলার রায় ঘোষণার পর থেকেই রাজ্যজুড়ে যোগ্য ও অযোগ্য প্রার্থীদের নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী মিলিয়ে মোট ২৫ হাজার ৭৫৩ জনের চাকরি বাতিল করেছে আদালত। ২০১৬ সালের পুরো প্যানেলটি বাতিল হওয়ায় এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, এই বিপুল সংখ্যক চাকরিহারাদের মধ্যে কাদের বেতন ফেরত দিতে হবে এবং কাদের নয়? এই বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের আসল বক্তব্য কী, তা বিস্তারিতভাবে জেনে নেওয়া যাক।
সুপ্রিম কোর্টের স্পষ্ট নির্দেশ অনুযায়ী, সবাইকে বেতন ফেরত দিতে হবে না। কেবলমাত্র সেই সকল প্রার্থীকেই বেতন ফেরত দিতে হবে, যারা দুর্নীতির মাধ্যমে বা জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে চাকরি পেয়েছেন বলে প্রমাণিত হবেন। এখানেই প্রশ্ন উঠছে, ঠিক কতজন প্রার্থী এই ‘অযোগ্য’ তালিকায় পড়েন এবং তাদের চিহ্নিত করার প্রক্রিয়া কী হবে?
রায়ের কপিতে আদালত স্পষ্টভাবে জানিয়েছে, “যেসব প্রার্থীকে সরাসরি দুর্নীতিগ্রস্ত বলে চিহ্নিত করা হয়নি, তাদের ক্ষেত্রেও পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়াটি গুরুতর অনিয়ম ও বেআইনি কার্যকলাপের কারণে সম্পূর্ণ বাতিল বলে ঘোষণা করা হয়েছে। এটি সংবিধানের ১৪ এবং ১৬ নম্বর অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন। তাই, এই প্রার্থীদের নিয়োগও বাতিল করা হল। তবে যারা ইতিমধ্যে চাকরিতে যোগ দিয়েছেন, তাদের কোনও অর্থ বা বেতন ফেরত দিতে হবে না। যদিও, তাদের চাকরি শেষ হয়ে যাবে। তাছাড়া, যেহেতু পুরো পরীক্ষার ফলাফল এবং প্রক্রিয়াটি বাতিল করা হয়েছে, তাই এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কেউ নতুন করে নিয়োগও পেতে পারবেন না।”
অর্থাৎ, সুপ্রিম কোর্টের বক্তব্য অনুযায়ী, যাদের নিয়োগ অবৈধ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হয়েছে কিন্তু তারা নিজেরা কোনো দুর্নীতিতে যুক্ত ছিলেন না, তাদের চাকরি বাতিল করা হলেও পূর্বে পাওয়া বেতন বা অন্য কোনো আর্থিক সুবিধা ফেরত দিতে তারা বাধ্য নন। এই অংশটি চাকরিহারা বহু মানুষের জন্য কিছুটা হলেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে সাহায্য করবে।
আগের চাকরিতে ফেরার সুযোগ:
তবে এখানেই শেষ নয়। সুপ্রিম কোর্ট চাকরিহারাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগের কথা উল্লেখ করেছে। রায়ে বলা হয়েছে, যেসব প্রার্থী পূর্বে রাজ্য সরকারের অন্য কোনও দফতর বা স্বায়ত্তশাসিত সংস্থায় কর্মরত ছিলেন, তারা চাইলে পুনরায় সেই পদে যোগ দিতে পারবেন। এই সংক্রান্ত তাদের আবেদন সংশ্লিষ্ট দফতর বা সংস্থা তিন মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে বাধ্য থাকবে।
সার্ভিস ব্রেক হবে না:
আগের চাকরিতে ফিরে গেলে ওই প্রার্থীদের চাকরির মেয়াদে কোনও ছেদ ধরা হবে না। এর অর্থ হল, তাদের পদমর্যাদা (স seniority), বেতন বৃদ্ধি (increment) এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা অক্ষুণ্ণ থাকবে। তবে, বাতিল হওয়া নিয়োগের সময়কালের জন্য তারা কোনও বেতন পাবেন না। আদালত আরও জানিয়েছে, যদি প্রয়োজন হয়, তবে এই প্রার্থীদের জন্য নতুন পদ তৈরি করেও নিয়োগ করা যেতে পারে।
জালিয়াতি করা প্রার্থীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা:
অন্যদিকে, যারা দুর্নীতির মাধ্যমে বা প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে চাকরি পেয়েছেন, তাদের ক্ষেত্রে আদালত কঠোর অবস্থান নিয়েছে। তাদের চাকরি তো বাতিল হবেই, পাশাপাশি তাদের আগের পাওয়া সমস্ত বেতনও ফেরত দিতে হবে। সুপ্রিম কোর্ট এই কাজটিকে সুস্পষ্ট প্রতারণা (cheating) হিসেবে চিহ্নিত করেছে এবং হাইকোর্টের এই সংক্রান্ত সিদ্ধান্তকে বহাল রেখেছে।
এই রায়ের ফলে একদিকে যেমন অবৈধ উপায়ে চাকরি পাওয়া প্রার্থীদের বিরুদ্ধে কঠোর বার্তা দেওয়া হল, তেমনই যাদের ক্ষেত্রে কোনও ব্যক্তিগত দুর্নীতি ছিল না, তাদের জন্য একটি ন্যায্য পুনর্বাসনের সুযোগও রাখা হল। এখন দেখার বিষয়, রাজ্য সরকার এই রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী পদক্ষেপ কীভাবে নেয় এবং যোগ্য ও অযোগ্য প্রার্থীদের চিহ্নিত করার প্রক্রিয়া কত দ্রুত ও স্বচ্ছভাবে সম্পন্ন হয়। এই সিদ্ধান্তের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীরা দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর একটি সুস্পষ্ট দিশা পেলেন, যদিও অনেকের কর্মজীবনের অনিশ্চয়তা এখনও কাটেনি।