অর্থনীতিটেক নিউজনিউজ

বিশেষ: শুধুমাত্র মেধা আর পরিশ্রম, শূণ্য থেকে ৫০ বিলিয়নে যাওয়ার গল্প, জেনেনিন আপনিও

আজকের বিশ্বের যে কোনও ওয়েবসাইট র‌্যাঙ্কিয়ে ফেসবুক এক অথবা দুই নম্বরে আছে। এত অল্প সময়ে কোনও ওয়েব সার্ভিস এত সাফল্য অর্জন করার নজির খুব বেশি নেই। আর ফেসবুকের এই অবিশ্বাস্য উত্থানের পেছনে যে মানুষটির সবথেকে বড় অবদান তাঁকে আমরা মোটামুটি সবাই এক নামে চিনি। হ্যাঁ – ফেসবুকের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান নির্বার্হী কর্মকর্তা মার্ক জুকারবার্গের কথাই বলা হচ্ছে।

আমরা সবাই কমবেশি এটুকু তথ্য জানি যে জুকারবার্গ ফেসবুকের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। কিন্তু কিভাবে তিনি এই অবিশ্বাস্য সফলতার দেখা পেলেন? কিভাবে একজন মেধাবী ছাত্র হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মত জায়গা ছেড়ে দিয়ে শুধুমাত্র একটি ওয়েবসাইট, নিজের মেধা আর আত্মবিশ্বাসকে পুঁজি করে আজকের পর্যায়ে পৌঁছালেন? চলুন আজ আমরা জেনে নিই মার্ক জুকারবার্গের সাফল্যযাত্রার খুঁটিনাটি।

এক নজরে মার্ক জুকারবার্গ:
১৯৮৪ সালের ১৪ই মে নিউ ইয়র্কের হোয়াইট প্লেইন্স এ জন্ম নেয়া মার্ক-এলিয়ট-জুকারবার্গ তাঁর কলেজের হলে বসে ফেসবুক সহপ্রতিষ্ঠা করেন। স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময়ে তিনি তাঁর ওয়েবসাইটে পূর্ণ সময় দেয়ার জন্য পড়াশুনা ছেড়ে দেন। বর্তমানে তাঁর প্রতিষ্ঠিত ও মালিকানাধীন ফেসবুকের নিয়মিত ব্যবহারকারী ২০০ কোটির উপরে, এবং এটি বিশ্বের অন্যতম বৃহত্‍ মার্কেটিং প্লাটফর্ম। শুধুমাত্র ফেসবুকের আয় দিয়েই জুকারবার্গ একজন বিলিয়নেয়ারে পরিনত হয়েছেন। ২০১০ সালের অস্কার মনোনয়ন পাওয়া সোস্যাল নেটওয়ার্ক ছবিটি নির্মিত হয় জুকারবার্গের ফেসবুক প্রতিষ্ঠার কাহিনীকে ভিত্তি করে। বর্তমানে ফেসবুক ছাড়াও বেশ কয়েকটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান চালান জুকারবার্গ।

শুরুর কথা:
হোয়াইট প্লেইন্সে বসবাসকারী এক শিক্ষিত ও স্বচ্ছল আমেরিকান ইহুদী পরিবারে জন্ম হয় মার্ক জুকাবার্গের। তাঁর বাল্যকাল কাটে হোয়াইট প্লেইন্স এর নিকটবর্তী গ্রাম ডোবস্ ফেরিতে। মার্কের বাবা এডওয়ার্ড জুকারবার্গ তাঁদের বাড়ির সাথে লাগোয়া চেম্বারে দাঁতের চিকিত্‍সা করতেন। তাঁর মা ক্যারেন মার্ক ও তাঁর এক ভাই র‌্যানডি, এবং দুই বোন ডোনা এবং এ্যারিয়েলির জন্মের আগ পর্যন্ত একজন মানসিক চিকিত্‍সক হিসেবে কাজ করতেন।

বাবা ও মা দু’জনেই চিকিত্‍সক হলেও ছোটবেলাথেকেই মার্কের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ছিল কম্পিউটার। ১২ বছর বয়সেই তিনি তাঁর বাবার কাজের সুবিধার জন্য “জুকনেট” নামে একটি মেসেজিং সফটঅয়্যার তৈরী করেন যার ফলে রিসিপশনিস্ট এবং তাঁর বাবাকে চেঁচিয়ে নিজেদের মধ্যে তথ্য আদান প্রদান করতে হত না। বাবার অফিস ছাড়াও জুকনেট দিয়ে জুকারবার্গ পরিবার ঘরের ভেতর নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করত। শুধুমাত্র মজা করার ছলে বালক মার্ক তাঁর কয়েকজন বন্ধুর সাথে মিলে একটি কম্পিউটার গেমও তৈরী করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য ছিল -“আমার কয়েকজন শিল্পী বন্ধু ছিল। ওরা বাসায় এসে বিভিন্ন জিনিস আঁকাআঁকি করত, আর আমি সেগুলো কাজে লাগিয়ে আমার গেম বানানোর কাজ করতাম।”
কম্পিউটারের প্রতি মার্কের উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকা আগ্রহের সাথে খাপ খাওয়াতে তাঁর পিতামাতা ডেভিড নিউম্যান নামে একজন কম্পিউটার শিক্ষককে রেখে দেন যিনি সপ্তাহে একদিন মার্কের বাসায় এসে তাঁকে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দিতেন। ডেভিড পরবর্তীতে মার্কের ব্যাপারে সাংবাদিকদের বলেছিলেন সেই ক্ষুদে জিনিয়াসের থেকে কম্পিউটারের জ্ঞানে এগিয়ে থাকাটা তাঁর জন্য যথেষ্ঠ কষ্টসাধ্য বিষয় ছিল। সেই সময়েই মার্ক বাড়ির কাছের মার্সি কলেজে পড়া শুরু করেন।

পরবর্তীতে নিউ হ্যাম্পশায়ারের নামকরা মাধ্যমিক বিদ্যালয় এক্সিটার এ্যাকাডেমিতে পড়াশুনা করেন। সেখানে পড়ার সময়ে তিনি ফেন্সিংয়ে বেশ ভাল দক্ষতা দেখাতে শুরু করেন এবং স্কুল ফেন্সিং টিম এর ক্যাপ্টেন নির্বাচিত হন। তিনি সাহিত্যেও বেশ প্রতিভার পরিচয় দিয়েছিলেন, ক্লাসিক সাহিত্যে তিনি একটি ডিপ্লোমাও অর্জন করেছিলেন। তবে সাহিত্যে ভার করলেও জুকার্বাগের মূল আগ্রহের স্থান সব সময়েই ছিল কম্পিউটার এবং তিনি প্রতিনিয়তই নতুন নতুন প্রোগ্রামের ওপরে কাজ করে চলেছিলেন।

উচ্চবিদ্যালয়ে পড়ার সময়েই তিনি প্যান্ডোরা মিউজিক সফটঅয়্যারের একটি প্রাথমিক সংস্করণ তৈরী করেন যা কিনে নেয়ার জন্য এ.ও.এল এবং মাইক্রোসফটের মত বড় বড় কোম্পানী তাদের আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। সফটঅয়্যার কিনে নেয়ার পাশাপাশি তাঁরা এই হাইস্কুল পড়ুয়া প্রতিভাবান কিশোর প্রোগ্রামারকে লোভনীয় চাকুরির প্রস্তাবও করেছিল – কিন্তু মার্ক তাদের সবগুলো প্রস্তাবই ফিরিয়ে দেন।

হার্ভাডে পড়াশুনা:
২০০২ সালে এক্সিটার থেকে পাশ করে বের হবার পর জুকারবার্গ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। দ্বিতীয় বর্ষে প্রবেশ করতে করতেই তিনি একটি পরিচিতি তৈরী করে নিয়েছিলেন যে “যদি কারও টুকিটাকি সফটঅয়্যার ডেভলপমেন্টের কাজ থাকে, তো মার্কের কাছে যাও।” সেই সময়েই তিনি “Coursematch” নামে একটি প্রোগ্রাম তৈরী করেন যেটি একজন শিক্ষার্থীকে অন্য শিক্ষার্থীদের কোর্স নির্বাচনের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে সুবিধাজনক ক্লাসটি বেছে নিতে সাহায্য করত। এছাড়াও তিনি “Facemash” নামে আরও একটি প্রোগ্রাম তৈরী করেছিলেন যেটি ক্যাম্পাসের যে কোনও দুইজন শিক্ষার্থীর ছবির মধ্যে তুলনা করত, এবং এদের মধ্যে কে বেশি আকর্ষণীয় তা নির্বাচনের জন্য অন্য ইউজাররা ভোট দিতে পারত। প্রোগ্রামটি তুমুল জনপ্রিয়তা পেলে ও ক্যাম্পাস কতৃপক্ষ এটিকে দৃষ্টিকটু বিবেচনা করে ক্যাম্পাসে সফটঅয়্যারটির ব্যবহার বন্ধ করে দেয়।

এই সাইটে তাঁরা ব্যবহারকারীদের মেসেজ আদান প্রদান, নিজেদের ছবি ও তথ্য শেয়ার করার সুবিধা দেয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। এইসাইটটি ডিজাইন করতে হার্ভার্ড স্টুডেন্ট নেটওয়ার্ককে ব্যবহার করা হয়েছিল। হার্ভাড এলিটদের ডেটিং এর সুবিধা দেয়া ছিল এর মূল উদ্দেশ্য। জুকারবার্গ এই প্রকল্পে কাজ করতে প্রথমে রাজি হলেও পরে প্রকল্প থেকে বের হয়ে গিয়ে তাঁর তিন বন্ধু ডাসটিন মস্কোভিজ, ক্রিস হাগ্স এবং এদুয়ার্দো স্যাভেরিনকে নিয়ে তাঁর নিজের সামাজিক যোগাযোগের সাইট নিয়ে কাজ করতে শুরু করেন।

জুকারবার্গ এবং তাঁর বন্ধুদের নতুন এই সাইটটি এর ব্যবহারকারীদের নিজস্ব প্রোফাইল তৈরী, ছবি আপলোড এবং অন্য ব্যবহারকারীদের সাথে যোগাযোগের সুবিধা দিতো। প্রাথমিক ভাবে “The Facebook” নামের সাইটটির ডেভলপমেন্টের কাজ তাঁরা ২০০৪ সাল পর্যন্ত হার্ভাডের একটি ছাত্রাবাসের রুমে বসে করেছিলেন। হার্ভার্ডের দ্বিতীয় বর্ষ শেষ করে জুকারবার্গ ফেসবুকের পেছনে তাঁর পূর্ণ সময় ও মনযোগ দেয়ার উদ্দেশ্যে পড়াশুনা ছেড়ে দিলেন। হার্ভার্ড থেকে বের হয়ে তিনি তাঁর কোম্পানীকে ক্যালিফোর্নিয়ার পাওলো আলটোতে স্থানান্তর করলেন। ২০০৪ সালের শেষে ফেসবুকের ব্যবহারকারী দাঁড়ালো ১০ লক্ষ।

ফেসবুকের উত্থান:
২০০৫ সালে ফেসবুক বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান এসেল পার্টনার্স এর কাছ থেকে একটি বিশাল সহায়তা পেল। এসেল নেটওয়ার্কটিতে এক কোটি সাতাশ লক্ষ মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করল যা কিনা সেই সময়ে শুধুমাত্র “ইভে লিগ” এর শিক্ষার্থীদের জন্য বরাদ্দ ছিল। জুকারবার্গের কোম্পানী এরপর ফেসবুকে অন্যান্য স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক কলেজ ও বিদ্যালয়য়ের শিক্ষার্থীদের তাদের সাইটে প্রবেশাধিকার দিলো যার ফলে সাইটের সদস্য সংখ্যা ২০০৫ এর ডিসেম্বরের মধ্যে ৫.৫ মিলিয়নে পৌঁছে গিয়েছিল।

সক্রিয় ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে ফেসবুক অন্যান্য কোম্পানীর নজরে পড়তে শুরু করল। তারা এই জনপ্রিয় নেটওয়ার্কটিতে তাদের পন্যের বিজ্ঞাপন প্রচারের কাজে লাগাতে চাইল। অনেকেই তাঁর কোম্পানীকে বিশাল অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে কিনে নিতেও চাইল। কিন্তু মার্ক ইয়াহু এবং এমটিভি নেটওয়ার্কের মত প্রতিষ্ঠানের লোভনীয় প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে তাঁর সাইটের উন্নয়নে মনযোগ দিলেন। বাইরের প্রোগ্রামারদের ফেসবুকে কাজ করার জন্য ডাকা হল, এবং প্রতিনিয়ত ফেসবুকে নতুন নতুন ফিচার যোগ হতে থাকল।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছিল জুকারবার্গের পথ শুধুমাত্র উন্নতির দিকেই ধাবিত হবে। কিন্তু ২০০৬ সালে জুকারবার্গকে প্রথমবারের মত বড় একটি বিপাকে পড়তে হল। জুকারবার্গের সাবেক প্রকল্প হার্ভার্ড কানেশনের উদ্যোক্তারার দাবি করলেন যে জুকারবার্গের ফেসবুকের আইডিয়া আসলে তাঁদের হার্ভার্ড কানেশনের আইডিয়া থেকে চুরি করা। এবং তাঁরা দাবি করলেন তাঁদের ব্যবসার ক্ষতির জন্য জুকারবার্গকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। জুকারবার্গ বললেন দুটি নেটওয়ার্ক দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম, কিন্তু আইনজীবিরা সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে ফেসবুকের ইন্সট্যান্ট মেসেজিং খুব সম্ভবত হার্ভার্ড কানেকশনের প্রাথমিক আইডিয়া থেকে চুরি করা এবং জুকারবার্গ ফেসবুক ব্যবহারকারীদের কিছু ব্যক্তিগত তথ্য তাঁর বন্ধুদের হাতে তুলে দিয়েছেন।

পরবর্তীতে জুকারবার্গ অবশ্য মেসেজিং সিস্টেমের তথ্য হাতবদল হওয়ার জন্য দি নিউ ইয়র্কার এর সাথে এক সাক্ষাত্‍কারে জুকারবার্গ ক্ষমা প্রার্থনা করে বলেছিলেন “আপনি যদি একটি সার্ভিস তৈরী করেন যা মানুষের ওপর প্রভাব ফেলবে এবং যার ওপর মানুষ ভরসা করবে, তাহলে আপনার আচরন পরিনত হওয়া উচিত্‍, তাই নয়কি? আমার মনে হয় (এখন) আমি পরিনত এবং আমি অনেক কিছুই শিখেছি।”

যদিও দুই পক্ষের মাঝে সাড়ে ছয় কোটি ডলারের একটি প্রাথমিক সুরাহা হয়েছিল, কিন্তু পরবর্তীতে এই আইনি বিরোধ ২০১১ সাল পর্যন্ত চলেছিল, কারন নরেন্দ্র এবং উইনকিলোভস ভাতৃদ্বয় আবার দাবি করেছিলেন যে তাঁদের স্টকের মূল্যের ব্যাপারে তাদের ভুল তথ্য দেয়া হয়েছিল।

এরপর ২০০৯ সালে জুকারবার্গকে আবার একটি ব্যক্তিগত বিপত্তির মুখে পড়তে হয়েছিল যখন লেখক বেন মেজরিচের “এ্যাক্সিডেন্টাল বিলিয়নেয়ারস” বইটি প্রকাশ পেল। বেশকিছু কাল্পনিক অধ্যায়, কাল্পনিক চরিত্র, এবং ভাবনাপ্রসূত সংলাপের সমন্বয়ে লেখা বইটির জন্য মেজরিচকে বেশ বড় আকারের সমালোচনার তোপ সামলাতে হয়েছিল্। তবে বইটির কাহিনী কতটা বাস্তবসম্মত এই বিষয়ে যথেষ্ঠ সন্দেহের অবকাশ থাকার পরও মেজরিচ তাঁর বইটির সত্ব চিত্রনাট্যকার এ্যারন সরকিনের কাছে বিক্রয় করতে সমর্থ হন এবং পরবর্তীতে একটি প্রশংসিত সিনেমা হিসেবে “দি সোস্যাল নেটওয়ার্ক” আটটি অস্কার মনোনয়ন জিতে নেয়।

সিনেমাটির কাহিনীর বিষয়ে জুকারবার্গ বেশ জোরালো প্রতিবাদ করেছিলেন। দি নিউ ইয়র্কারের এক রিপোর্টারকে তিনি বলেছিলেন যে সিনেমাটির অনেক খুঁটিনাটি বিষয়ই সঠিক ছিল না। যেমন ২০০৩ সাল থেকে একজন চীনা-আমেরিকান মেডিক্যাল শিক্ষার্থী প্রিসিলা চ্যান এর সাথে প্রনয়ের সম্পর্কে জড়িত ছিলেন। প্রিসিলার সাথে তাঁর হার্ভার্ডে পরিচয় হয়েছিল – কিন্তু সিনেমায় সেই ব্যাপারটিকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এছাড়াও কোনওদিনও তাঁর কোনও “ফাইন্যাল ক্লাবে” যোগ দেয়ার ইচ্ছে ছিল না। ফাইন্যাল ক্লাব হচ্ছে হার্ভার্ড এর ছাত্রদের নিজেদের গড়া সামাজিক ক্লাব যা হার্ভার্ড কতৃপক্ষের সাথে সম্পর্কযুক্ত নয়। প্রথম ফাইন্যাল ক্লাবটির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৭৯১ সালে। ২০১০ সালে নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য আয়োজিত একটি সম্মেলনে যোগ দিয়ে জুকারবার্গ এক রিপোর্টারকে বলেছিলেন – “তারা যেসব ব্যাপারে সত্যিটা তুলে ধরতে চেষ্টা করেছে সেগুলো আসলে খুবই মজার, যেমন সিনেমায় আমার চরিত্রের পরা প্রতিটি শার্ট এবং সোয়েটার আসলেই আমার নিজের গুলোর মত। শুধু কিছু সাধারন বিষয় ঠিক রাখা ছাড়া তারা প্রায় সব বিষয়ই ভুল ভাবে উপস্থাপন করেছে।
তবে এসব সমালোচনা ও বিতর্কের পরও জুকারবার্গ এবং তাঁর ফেসবুক ধারাবাহিক ভাবেই সাফল্যের পথে এগিয়ে গেছে। ২০১০ সালে টাইম ম্যাগাজিন জুকারবার্গকে তাদের বর্ষসেরা ব্যক্তিত্ব ঘোষণা দেয়, এছাড়াও ভ্যানিটি ফেয়ার তাঁকে তাদের নতুন প্রতিষ্ঠানের তালিকার শীর্ষে স্থান দেয়। ফোর্বস ম্যাগাজিনের শ্রেষ্ঠ ৪০০ ধনী ব্যক্তির তালিকায় এ্যাপলের স্টিভ জবসকে পেছনে ফেলে তিনি ৩৫ তম স্থান দখল করে নেন। সেই সময়ে তাঁর মোট সম্পদের আনুমানিক পরিমান ছিল ৬.৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

জনহিতকর কার্যক্রম:
ফেসবুকের থেকে বিশাল সম্পদের অধিকারী হওয়ার মূহুর্ত থেকেই জুকারবার্গ তাঁর বিপুল অর্থের একটি বড় অংশ জনহিতকর কার্যক্রমে ব্যয় করতে শুরু করেন। এরমধ্যে সবথেকে উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে, যখন তিনি নিউ জার্সির ভঙ্গুর পাবলিক স্কুল ব্যবস্থাকে টেনে তোলার জন্য ১০ কোটি মার্কিন ডলার অনুদান প্রদান করেন। সেই বছরের ডিসেম্বরে জুকারবার্গ “দানের শপথনামায়” স্বাক্ষর করেন। এই শপথনামায় সই করার মাধ্যমে তিনি তাঁর জীবনে অর্জিত আয়ের ৫০ শতাংশ দাতব্য কাজে ব্যয় করার প্রতিজ্ঞা করেন। এর আগে জর্জ লুকাস, ওয়ারেন বাফেট এবং বিল গেটসের মত ব্যক্তিরা একই ধরনের শপথনামায় স্বাক্ষর করেছিলেন। স্বাক্ষরের পর জুকারবার্গ অন্যান্য তরুণ ধনী উদ্যোক্তাদেরও তাঁর মত দাতব্য কাজে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে বলেন – “নিজেদের প্রতিষ্ঠানের সাফল্যের কারনে প্রাচূর্যের অধিকারী হয়েছে এমন তরুণ উদ্যোক্তাদের একটি প্রজন্মের সামনে তাদের তরুণ বয়সেই (তাদের সৌভাগ্যের) প্রতিদান দিয়ে আমাদের জনহিতকর প্রচেষ্টার ফলাফল চাক্ষুষ করার সুযোগ রয়েছে।”

২০১৩ সালে ফরচুন ম্যাগাজিনের সেরা ৫০০ তালিকায় ফেসবুক প্রথমবারে মত স্থান করে নেয়। ২৮ বছর বয়সী জুকারবাগ সর্ব কনিষ্ঠ সিইও হিসেবে তালিকায় স্থান পেয়ে ইতিহাস গড়েন।

ফেসবুকের পাবলিক লিমিটেড হয়ে ওঠা:
২০১২ সালের মে মাসে জুকারবার্গের জীবনধারায় দুইটি বড় পরিবর্তন আসে। পাবলিক লিমিডেট কোম্পানী হিসেবে ফেসবুক প্রথমবারের মত বাজারে শেয়ার ছেড়ে ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অর্থসমাগম ঘটায়, ইতোপূর্বে কোনও ইন্টারনেট ভিত্তিক কোম্পানী এতবড় আইপিও অর্জন করতে পারেনি। জুকারবার্গের কোম্পানী কিভাবে এই বিপুল পরিমান অর্থের ব্যবহার করবে তা দেখার জন্য অনেকেই মুখিয়ে ছিলেন। তবে জুকারবার্গ তাঁর প্রতিষ্ঠানের ব্যাপ্তি বাড়ানোর পরিকল্পনা করছিলেন কারন তার আগের মাসেই তিনি নিজে ইনস্টাগ্রাম কেনার ব্যবসায়িক আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন।

কোম্পানীর শেয়ার বাজারে ছাড়ার পরের প্রাথমিক সাফল্যের পর ফেসবুকের শেয়ারের দাম বেশ পড়ে গেলেও জুকারবার্গ যে বাজারে তাঁর প্রতিষ্ঠানের উত্থান ও পতনের সময়ে সাহস নিয়ে হাল ধরবেন এতে কোনও সন্দেহ ছিল না।

ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন:
আগের অংশে বলা হয়েছিল যে ২০১২ এর ১৯শে মে জুকারবার্গের জীবনধারায় দু’টি বড় পরিবর্তন এসেছিল। প্রথমটি ছিল শেয়ার বাজারে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানী হিসেবে ফেসবুকের পদার্পণ। দ্বিতীয়টি চাক্ষুষ করতে ক্যালিফোর্নিয়ার পাওলো আলটোতে অবস্থিত জুকারবার্গের বাড়িতে সেদিন ১০০ অতিথির সমাগম হয়েছিল। অতিথিরা ভেবেছিলেন যে তাঁরা মার্কের দীর্ঘদিনের প্রেমিকা প্রিসিলা চ্যান এর মেডিক্যাল কলেজ গ্রাজুয়েশন উদযাপন করতে এসেছেন। কিন্তু তাঁরা অবাক হয়ে দেখলেন তাঁদের সামনে এই যুগল যাজকের সামনে তাঁদের বিবাহ-প্রতিশ্রুতি বিনিময় করছেন।

২০১৫ সালের নভেম্বরে মার্ক ও প্রিসিলা তাঁদের প্রথম কন্যাসন্তান ম্যাক্সকে পৃথিবীর বুকে স্বাগত জানান। ম্যাক্সের জন্মের পর বাবা জুকারবার্গ পরিবারকে সময় দেয়ার জন্য দুই মাসের পিতৃত্বের ছুটিতে যাওয়ার ঘোষণা দেন। এই সময়ে তিনি ও প্রিসিলা তাঁদের কন্যার উদ্দেশ্যে একটি খোলা চিঠি প্রকাশ করেন এই মর্মে যে তাঁরা তাঁদের অধিকারে থাকা ফেসবুকের শেয়ারের ৯৯ শতাংশ দাতব্য কাজে দান করে যাবেন। চিঠিতে তাঁরা লেখেন “আমরা আমাদের ক্ষূদ্র সামর্থ দিয়ে পৃথিবীকে সব শিশুর জন্য আরেকটু সুন্দর স্থান বানানোর ব্যাপারে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আমরা আমাদের ফেসবুক শেয়ারের ৯৯ শতাংশ – যা বর্তমানে প্রায় ৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার – অন্য অনেকে যারা পরবর্তী প্রজন্মের কল্যানে পৃথিবীকে আরও সুন্দর করার প্রয়াসে নেমেছেন তাঁদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে দান করে যাব।”

পরবর্তী বছরের সেপ্টেম্বরে এই দম্পতি ঘোষণা দেন যে “চ্যান-জুকারবার্গ ইনিশিয়েটিভ” (সি জেড আই) – যেই সংস্থায় তাঁরা তাঁদের ফেসবুক শেয়ার দান করেছেন, তারা আমাদের সন্তানদের জীবনকালে যত প্রকারে রোগ হতে পারে তার সবগুলোর প্রতিকার আবিষ্কারের বৈজ্ঞানিক গবেষণায় অন্তত তিন বিলিয়ন মার্কিন ডলারের তহবিল বরাদ্দ করবে। রকফেলার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত নিউরো সাইন্টিস্ট ড. কোরি বার্গম্যানকে সি জেড আই এর প্রেসিডেন্ট অব সাইন্স হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। এরপর তারা চ্যান-জুকারবার্গ বায়োহাব প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। এই বায়োহাবটি সান ফ্রান্সিসকো ভিত্তিক একটি স্বায়ত্বশাসিত বৈজ্ঞানিক গবেষণা কেন্দ্র যেখানে প্রকৌশলী, কম্পিউটার বিজ্ঞানী, রসায়নবিদ, পদার্থবিদ, প্রাণরসায়নবিদ – ইত্যাদি সব ধরনের বৈজ্ঞানিকদের একটি মিলনমেলা ঘটবে এবং তাঁরা একসাথে কাজ করবেন। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, সানফ্রান্সিস্কো বিশ্ববিদ্যালয়, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, বারকেলি বিশ্ববিদ্যালয়ের মত প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে একসাথে কাজ করার চুক্তিতে আবদ্ধ গবেষণা কেন্দ্রটির জন্য দশ বছর ধরে প্রদেয় ৬০০ মিলিয়ন ডলারের একটি প্রাথমিক তহবিল বরাদ্দ করা হয়।

২০১৭ সালের মার্চে জুকারবার্গ দম্পতি ঘোষণা দেন তাঁরা তাঁদের দ্বিতীয় সন্তান আশা করছেন। সেই বছরের ২৮শে আগ্স্ট তাঁদের দ্বিতীয় কন্যা অগাস্ট পৃথিবীর আলোর মুখ দেখে। অগাস্টের জন্মের পর জুকারবার্গ ফেসবুকে লেখেন যে তাঁর প্রথম চাওয়া ছিল শিশুটি যেন সুস্থ হয়, এবং দ্বিতীয় চাওয়া ছিল শিশুটি যেন মেয়ে হয়। একটি বোন পাওয়ার থেকে ম্যাক্সের জন্য ভাল আর কিছু হতে পারত না।

জুকারবার্গ এবং ফেসবুক এখনও তাদের সাম্রাজ্য বিস্তার করে চলেছে। মার্কের মত এত কম বয়সে শুধুমাত্র নিজের বুদ্ধি, প্রতিভা আর কর্ম দিয়ে এতবড় সাফল্যের দেখা পৃথিবীতে খুব কম মানুষই পেয়েছেন। তাঁকে এবং ফেসবুককে ঘিরে কিছু বিতর্ক আছে, এবং হয়তো তার কিছু কিছু সঠিকও। কিন্তু তাই বলে তাঁর সাফল্য ছোট হয়ে যায় না। সামনে অনেক সময় এখনও পড়ে আছে। এখন দেখার বিষয় মার্ক জুকারবার্গ আমাদের আর কি জাদু দেখান।

Back to top button