অর্থনীতিনিউজ

বিশেষ: কলেজের ভর্তির পরীক্ষায় ৪ বার ফেল, আজ কোটি কোটি টাকার মালিক জ্যাক মা

জ্যাক মা এর জীবনী মানে শুধু একটি সাফল্যগাথা নয়; জ্যাক মার জীবনী একটি ইতিহাস আর অনুপ্রেরণা। চরম দুরাবস্থা আর ব্যর্থতার মাঝে স্বপ্ন আর আশার আলো জ্বেলে রাখার উদাহরণ। চলুন ঘুরে আসি এই অসাধারণ মানুষটির জীবনের ইতিহাস থেকে।

কে এই জ্যাক মা?
আসল নাম: মা ইউন

যে কারণে বিখ্যাত: আলিবাবা ডট কম ও আলিবাবা গ্র্রুপের প্রতিষ্ঠাতা, সাবেক সিইও, বর্তমান এক্সিকিউটিভ চেয়ারম্যান।

মোট সম্পদ: ৪০.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (এপ্রিল ২০১৯)

জন্ম: ১৫ই অক্টোবর, ১৯৬৪

দেশ: চীন

জ্যাক মার জীবনী:
যদি আপনিও স্বপ্ন দেখেন নিজের চেষ্টা, মেধা, আর শ্রম দিয়ে একদিন নিজেকে ও পৃথিবীকে বদলে দেয়ার – তবে আপনার জন্য লড়াকুর উপহার: বাংলা ভাষায় জ্যাক মার পূর্ণাঙ্গ জীবন কাহিনী।

এক নজরে জ্যাক মার কাহিনী :
জ্যাক মা একজন চীনা উদ্যোক্তা, যিনি বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় অনলাইন পাইকারী ক্রয়-বিক্রয় সাইট আলিবাবা’র প্রতিষ্ঠাতা , সাবেক সিইও, ও বর্তমান নির্বাহী চেয়ারম্যান। ২০১৯ এর এপ্রিল মাসের হিসাব অনুযায়ী তাঁর বর্তমান সম্পদের পরিমান ৪০.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার! এই বিপুল সম্পদ তাঁকে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে ধনী মানুষদের একজন করেছে।

বিশ্বের সাম্প্রতিক ইতিহাসে ব্যবসা বানিজ্যকে আজকের পর্যায়ে নিয়ে আসার পেছনে যে কয়জন মানুষের অবদান সবচেয়ে বেশি – জ্যাক মা, তাঁদের মধ্যে অন্যতম।

ফোর্বস ম্যাগাজিন তাঁকে প্রায় প্রতি বছরই বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ও প্রভাবশালী মানুষদের একজন হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। ২০১৭ সালে ফরচুন ম্যাগাজিন তাঁকে পৃথিবীর সেরা ৫০ জন নেতার তালিকায় ২য় স্থান দেয়।

জ্যাক মা এর বেড়ে ওঠা ও শিক্ষা:
জ্যাক মার জীবন কাহিনী নিয়ে সুপারহিট সিনেমা বানানো কোনও ব্যাপারই নয়। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়লে আপনিও স্বীকার করবেন।

“জ্যাক মা ইউন” এর জন্ম হয় ১৯৬৪ সালের ১৫ই অক্টোবর, চীনের ঝি-জিয়াং প্রদেশের হ্যাং-চাও শহরে, এক দরিদ্র পরিবারে।

তাঁর বাবা-মা ছিলেন পেশাদার গল্প বলিয়ে ও সঙ্গীত শিল্পী। এই পেশায় আয় রোজগার খুব বেশি হত না। দুই ভাই ও এক বোনের মাঝে দ্বিতীয় মা ইউন যে এতবড় বিজনেস ম্যাগনেট হবেন – তা কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি।

ছোটবেলায় তাঁর প্রথম প্যাশন ছিলো ইংরেজী ভাষা। ঐ বয়সেই তিনি বুঝে গিয়েছিলেন, অবস্থার পরিবর্তন করতে হলে ইংরেজী শেখার কোনও বিকল্প নেই। হ্যাং-চাও ইন্টারন্যাশনাল হোটেলে আসা ইংরেজী-ভাষী পর্যটকদের ফ্রি গাইড হিসেবে কাজ করতেন তিনি, ইংরেজী ভাষায় লিসনের বিনিময়ে!
৯ বছর ধরে তিনি ৭০ মাইল পথ সাইকেল চালিয়ে পর্যটকদের এলাকা ঘুরিয়ে দেখাতেন, শুধুমাত্র ইংরেজী শেখার জন্য!

এরকমই এক পর্যটকের সাথে তাঁর এক পর্যায়ে বন্ধুত্ব হয়ে যায়। সেই ব্যক্তিই মা ইউনকে ‘জ্যাক মা’ নাম দেন। কারণ চীনা নামটি ইংরেজদের জন্য উচ্চারণ করা কঠিন ছিলো।

ইলন মাস্ক বা বারাক ওবামার মত জ্যাক মা তুখোড় ছাত্র ছিলেন না। চীনে কলেজ ভর্তি পরীক্ষা বছরে মাত্র একবার হত। সব কলেজেই একই সময়ে পরীক্ষা হত, এবং পরীক্ষায় পাশ করে কলেজে সুযোগ পেতে জ্যাক মার ৪ বছর লেগেছিল।

তিনি ১৯৮৮ সালে হ্যাং-চাও টিচার্স ইন্সটিটিউট (বর্তমান ‘হ্যাং-চাও নরমাল ইউনিভার্সিটি) এর ইংরেজী বিভাগ থেকে বি.এ ডিগ্রী নিয়ে বের হন।

এর পর ২০০৬ সালে বেইজিং এর ‘চিউং-কং গ্রাজুয়েট স্কুল অব বিজনেস’ থেকে ব্যবসায় শিক্ষায় ডিগ্রী নেন।

ব্যর্থতা:
আলিবাবার আগে জ্যাক মা সত্যিসত্যিই একজন পুরোপুরি ব্যর্থ মানুষ ছিলেন। ৪বার ফেল করে কলেজে ঢোকার পর, যখন পাশ করে বের হলেন – তখন ব্যর্থতা কাকে বলে, তা তিনি আবারও হাড়ে হাড়ে টের পেলেন। জ্যাক মার জীবন কাহিনী এর সবচেয়ে করুণ, কিন্তু শক্তিশালী অংশ এটি।

‘হ্যাং-চাও দিয়ানজি ইউনিভার্সিটি’তে ইংরেজীর লেকচারার হিসেবে যোগ দেয়ার আগে, তিনি ৩০টি চাকরির জন্য চেষ্টা করেন, এবং প্রতিটিতেই ব্যর্থ হন।

আমেরিকান একটি টক শোতে সাক্ষা‌ত্‍কার দিতে গিয়ে জ্যাক মা বলেছিলেন :”আমি যখন পুলিশের চাকরির জন্য আবেদন করলাম, ১০ জনের মধ্যে ৯জনের চাকরি হল; আমাকে বলা হল, ‘তুমি উপযুক্ত নও’। – আমার শহরে যখন কেএফসি আসলো, আমরা ২৪ জন চাকরির আবেদন করেছিল। ২৩ জনের চাকরি হল, আমি বাদ পড়লাম। – হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে আমি ১০ বার আবেদন করে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলাম। তারপর চিন্তা করলাম ‘হয়তো একদিন আমি হার্ভার্ডে লেকচার দেব।”

আরেকটি সাক্ষা‌ত্‍কারে জ্যাক বলেছিলেন, “২০০৩ সালে যখন আমরা ‘তাওবাও’ শুরু করি, তখন আমার টিমের সবাইকে বলা হয়েছিল, বাসায় গিয়ে বিক্রী করার মত ৪টি জিনিস নিয়ে আসতে। আমাদের বেশিরভাগই বিক্রী করার মত ৪টি জিনিস বাসায় খুঁজে পাইনি। কারণ আমরা আর্থিক ভাবে খুবই গরিব ছিলাম।”

আলিবাবা কিন্তু জ্যাক মার প্রথম ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নয়। এর আগে দু’টো ব্যবসা শুরু করেছিলেন তিনি। এবং একটিতেও বলার মত সাফল্য পাননি। সে গল্প জানবেন পরের অংশে।

ইন্টারনেটের সাথে পরিচয়:
জ্যাক মা তাঁর ইংরেজী শিক্ষকের চাকরিটা বেশ উপভোগ করতেন। কিন্তু বেতন ছিল খুবই কম। মাসে মাত্র ১২ ডলার! এই সামান্য বেতনে বলতে গেলে কিছুই করা যায় না।

তাঁর উদ্দেশ্য ছিল দারিদ্র থেকে বের হয়ে আসা। এত কষ্ট করে পড়াশুনা করার পেছনেও দারিদ্র থেকে মুক্তি পাওয়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু পড়াশুনার পর সম্মানজনক একটা চাকরি পেয়েও তাঁর আর্থিক অবস্থা খারাপই রয়ে গেল।

জ্যাক মার এক সময়ে মনে হল, তিনি তো ইংরেজীর জ্ঞান কাজে লাগিয়েই একটি ব্যবসা শুরু করতে পারেন। ৯০ দশকের একদম শুরুর দিকে তিনি তাঁর অনুবাদ সংস্থা বা ট্রান্সলেশন ফার্ম খুলে বসলেন। অর্থের বিনিময়ে চীনা ভাষা থেকে ইংরেজী, এবং ইংরেজী থেকে চীনা ভাষায় বিভিন্ন জিনিস অনুবাদ করতেন। মাঝে মাঝে দোভাষীর কাজও করতেন।

জ্যাক মা উক্তি
এরকম একটি দোভাষীর কাজ নিয়েই তিনি ১৯৯৫ সালে আমেরিকা যান। এর এক বছর আগে তিনি প্রথমবার ইন্টারনেট সম্পর্কে জেনেছিলেন। আমেরিকায় যাওয়ার পর প্রথম তিনি স্বচক্ষে ইন্টারনেট দেখেন, এবং বিষয়টি তাঁকে দারুন প্রভাবিত করে।

বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয়, আজকের দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ইন্টারনেট ভিত্তিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের একটির প্রতিষ্ঠাতা-মালিক ৩০ বছর বয়স পার করে ইন্টারনেটের সাথে পরিচিত হয়েছিলেন।

জ্যাক মা ইন্টারনেটে প্রথম যে শব্দটি লিখে সার্চ দেন, তা ছিল “বিয়ার”। বিভিন্ন দেশের বেশ কয়েকটি কোম্পানীর বিয়ার সার্চ এলেও চীনের কোনও কোম্পানী সেখানে ছিলো না। যদিও চীনে বেশ ভালো বিয়ার তৈরী হত। এছাড়া, তিনি চীন সম্পর্কে আরও কিছু বিষয় সার্চ করেন, কিন্তু তেমন কিছুই পাওয়া যায় না। বিষয়টি জ্যাক মাকে বেশ ভাবনায় ফেলে। এবং তখন থেকেই তাঁর মাথায় ইন্টারনেট ব্যবহার করে ব্যবসা করার চিন্তা আসে।

তিনি ইন্টারনেট সম্পর্কে বলতে গেলে কিছুই জানতেন না। এমনকি কম্পিউটারও ভালো করে চালাতে জানতেন না। কিন্তু তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, এ জিনিস একদিন পৃথিবীর ইতিহাস নতুন করে লিখবে।

জ্যাক মার ব্যবসায়িক ইতিহাস ও ক্যারিয়ার:
আলিবাবার আগে:
প্রথম ইন্টারনেট ব্যবহার করে চীন সম্পর্কে তেমন কোনও তথ্য না পেয়ে, জ্যাক সেই সময়েই তাঁর আমেরিকান বন্ধুদের সহায়তায় চীন সম্পর্কিত একটি ওয়েবসাইট খোলেন।

ওয়েবসাইটি চালু হয় সকাল ৯:৪০ এ, এবং দুপুর ১২:৩০ এর মধ্যেই চীনের বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী তাঁর সাথে কথা বলার জন্য ই-মেইল করেন! জ্যাক মা সাথে সাথে বুঝে যান, ইন্টারনেট দিয়ে ব্যবসা শুরু করা যায়।

১৯৯৫ সালের এপ্রিলে জ্যাক মা, স্ত্রী ক্যাথি ঝাং, ও তাঁর কয়েকজন বন্ধু ও মিলে ২০,০০০ মার্কিন ডলার যোগাড় করে তাঁদের প্রথম কোম্পানী শুরু করেন। “চায়না পেজেস” নামের এই কোম্পানী অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন চীনা প্রতিষ্ঠানকে ওয়েবসাইট তৈরী করে দিত।

কোম্পানীটি চালাতে জ্যাক মা তাঁর আমেরিকান বন্ধুদের সাহায্য নিতেন। চীনা কোম্পানীগুলোর সাথে যোগাযোগ, চুক্তি – ইত্যাদি তিনি নিজে দেখতেন।

২০১০ সালে একটি কনফারেন্সে জ্যাক মা বলেন যে তিনি জীবনে কোনওদিন এক লাইন কোড (প্রোগ্রাম) লেখেননি। ৩৩ বছর বয়সে প্রথম তিনি নিজের জন্য একটি কম্পিউটার কিনেছিলেন।

অন্য আরেকটি সাক্ষা‌ত্‍কারে তিনি বলেছিলেন, “প্রথম যেদিন আমরা ওয়েবে কানেক্ট হই, সেদিন আমি আমার বন্ধুবান্ধব ও কিছু টিভি সাংবাদিককে দাওয়াত করেছিলাম। খুবই ধীরগতির একটি ডায়াল আপ কানেকশন সেট করে আমি ইন্টারনেট চালু করেছিলাম। পেজটির অর্ধেক লোড হতেই সাড়ে ৩ ঘন্টা লেগেছিল। এই সময়টা আমরা খাওয়াদাওয়া ও আড্ডাবাজি করে কাটিয়েছিলাম। – কিন্তু আমার খুব গর্ব হচ্ছিল। আমি ওদের কাছে প্রমাণ করেছিলাম যে, ইন্টারনেট বলতে সত্যিই কিছু আছে!”

চায়না পেজেস কোম্পানীটি ৩ বছর চালানোর পর তাঁদের হাতে ৮ লাখ মার্কিন ডলারের মত মূলধন দাঁড়ায়। এরপর জ্যাক মার জীবন কাহিনী নতুন এক মোড় নেয়।

আলিবাবা অধ্যায়:
১৯৯৮ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত জ্যাক মা চীনের বৈদেশিক বানিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি আইটি কোম্পানীর প্রধান হিসেবে কাজ করেন।

১৯৯৯ সালে চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি নিজের শহর হ্যাং-চাও এ ফিরে আসেন এবং ১৮ জন বন্ধু মিলে অনলাইন পাইকারি পন্য বেচাকেনার সাইট আলিবাবা প্রতিষ্ঠার কাজে হাত দেন।

আলিবাবা এর নামকরন এর ইতিহাস বলতে গিয়ে, জ্যাক মা বলেছিলেন:

“শুরু করার সময়ে আমার মনেহয়েছিল, ইন্টারনেট যেহেতু একটি বৈশ্বিক ব্যাপার, আমাদের প্রতিষ্ঠানের নামটিও বৈশ্বিক হওয়া উচি‌ত্‍, সেইসাথে নামটি যেন সহজেই চেনা যায়। সেই সময়ে Yahooনামটি ছিল সেরা – আমি অনেক দিন ধরে এমন একটি নাম বের করার চেষ্টা করছিলাম । তারপর হঠা‌ত্‍ মনে হল আলিবাবা নামটি ভালো হতে পারে।

সৌভাগ্যই বলতে হবে, চিন্তাটি মাথায় আসার সময়ে আমি সানফ্রান্সিস্কোর একটি রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার খাচ্ছিলাম। ওয়েট্রিস খাবার সার্ভ করতে এলে, আমি তাকে বললাম আলিবাবাকে চেনে কিনা। সে বলল সে চেনে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আলিবাবা কি? – সে বলল “চিচিং ফাক”! – অসাধারণ!

রাস্তায় বের হবার পর আমি প্রায় ২০ জন মানুষকে আলিবাবা সম্পর্কে প্রশ্ন করলাম। সবাই আলিবাবা, ৪০ চোর ও তাদের গুপ্তধন – সবই জানে। আমি বুঝে গেলাম এটা আসলেই দারুন একটা নাম হতে পারে। বলতে গেলে সবাই এটা একবারে ধরতে ও মনে রাখতে পারবে, আর নামটা শুরু হয় A দিয়ে”।

১৯৯৯ এর অক্টোবর ও ২০০০ এর জানুয়ারীতে দুইবারে মোট ২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের ইনভেস্টমেন্ট পায় আলিবাবা।

তাঁদের এই পরিকল্পনার উদ্দেশ্য ছিল, চীন এর আভ্যন্তরীণ ই-কমার্স মার্কেটকে উন্নত করা। এবং সেই সাথে, চীন দেশের ক্ষূদ্র ও কুটির শিল্পকে আন্তর্জাতিক বাজারের প্রতিযোগীতায় এগিয়ে যেতে সাহায্য করা।

২০০৩ সালে জ্যাক মা আন্তর্জাতিক ই-কমার্স সিস্টেমের উন্নতির জন্য eBay এর আদলে Taobao Marketplace, আলি-পে, আলি মামা, এবং Lynx প্রতিষ্ঠা করেন।

এইসব উদ্যোগ সেই সময়ে পাগলামি হিসেবে দেখা হয়েছিল। কেউ ভাবেনি যে প্রতিটি উদ্যোগেই জ্যাক মা সফল হবেন। সেই সময়ে একটি পত্রিকা তাঁকে ‘ক্রেজি জ্যাক’ বা ‘পাগল জ্যাক’ – নামে অভিহিত করেছিল।

কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই দেখা গেল, তাওবাও দারুন সফল একটি ই-কমার্স সাইট হয়ে উঠেছে। এই সাফল্যের কারণে ই-বে বিপুল অর্থের বিনিময়ে তাওবাওকে কিনে নিতে চায়, কিন্তু জ্যাক মা সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন, এবং এর বদলে ইয়াহুর সহপ্রতিষ্ঠাতা জেরি ইয়াং এর কাছ থেকে ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ গ্রহণ করেন।

বর্তমানে তাওবাও মার্কেটপ্লেস বিশ্বের এক নম্বর ই-কমার্স ওয়েবসাইট। এবং বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ভিজিট হওয়া ওয়েবসাইটগুলোর মধ্যে অষ্টম। ২০১৮ সালের এ্যালেক্সা রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রতি মাসে গড়ে ৬১ কোটি ৭০ লাখ মানুষ সাইটটি ব্যবহার করে।

আলি পে (বর্তমান Ant Financial) পৃথিবীর সবচেয়ে দামী ‘ফিনটেক’ বা ফাইনানশিয়াল টেকনোলজি কোম্পানী, যার বর্তমান মার্কেট ভ্যালু ১৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার! – মূলত এই আলি-পে’র আইডিয়ার কারণেই জ্যাক মাকে পাগল খেতাব দেয়া হয়েছিল। বর্তমানে এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় মোবাইল এবং অনলাইন পেমেন্ট প্ল্যাটফর্ম।

২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে আলিবাবা নিউ ইয়র্ক স্টক এক্সেঞ্জ এ আইপিও ছাড়ে। এর মাধ্যমে তারা ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ পায়! এটি আমেরিকার অর্থনৈতিক ইতিহাসে সর্বোচ্চ আইপিওর ঘটনা – যা খোদ আমেরিকার কোনও কোম্পানী করে দেখাতে পারেনি।

বর্তমানে জ্যাক মা আলিবাবা গ্রুপের নির্বাহী চেয়ারম্যান। আলিবাবা গ্রুপের অধীনে মোট ৯টি বড় কোম্পানী রয়েছে।

২০১৭ সালে মা আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে সাক্ষা‌ত্‍ করেন এবং আমেরিকার বাজারে ১ মিলিয়ন চাকরি সৃষ্টির প্রতিশ্রুতি দেন।

২০১৮ সালের ১০ সেপ্টেম্বর তিনি ঘোষণা দেন, তিনি এক বছরের মধ্যে আলিবাবা থেকে পুরোপুরি অবসর নিয়ে শিক্ষার প্রসার ও মানব সেবার কাজে মনোনিবেশ করবেন।

এর আগে তিনি আলিবাবার সিইও পদ থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে নির্বাহী চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। জ্যাক মার কথা অনুযায়ী, প্রতিটি সফল মানুষের ৫০ বছর বয়স হওয়ার পর অর্থের চিন্তা ছেড়ে দিয়ে মানব সেবা ও নতুনদের সফল করার কাজে মনোনিবেশ করা উচিত্‍।

ব্যক্তিজীবন:
স্টিভ জবস এর মত জ্যাক মা-ও তাঁর পারিবারিক ও ব্যক্তিগত জীবনকে মিডিয়ার বাইরে রাখতে পছন্দ করেন। তাঁর পরিবারের আভ্যন্তরীণ বিষয় সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য পাওয়া যায় না।

ছাত্র অবস্থায় জ্যাক মার পরিচয় হয় ক্যাথি ঝাং এর সাথে। পরবর্তীতের তাঁরা বিয়ে করেন। জ্যাক মার সাফল্যের পেছনে ক্যাথির অবদান জ্যাক সব সময়েই স্বীকার করেন।

৫ ফুট ৫ ইঞ্চি উচ্চতার জ্যাক মোটেও সুদর্শন নন। ক্যাথির সাথে তাঁর পরিচয়ের সময়ে জ্যাক ছিলেন একজন ব্যর্থ মানুষ। কিন্তু তারপরও ক্যাথি জ্যাকের প্রেমে পড়েন। এ প্রসঙ্গে ক্যাথি পরে বলেছেন: “এটা ঠিক যে ও সুদর্শন নয়। কিন্তু ওর মাঝে এমন কিছু ব্যাপার ছিল, বা আছে, যা আমি অন্য কোনও পুরুষের মাঝে কখনওই খুঁজে পাইনি”।

জ্যাক মা তাঁর পরিবারের ব্যাপারে কতটা গোপনীয়তা রক্ষা করেন যে ১৯৯২ সালে জন্ম নেয়া তাঁর ছেলে মা ইউয়ানকুন বা জেরি মা – ছাড়া তাঁর বাকি দুই সন্তানের নাম বহুদিন পর্যন্ত গোপন ছিল। সম্প্রতি তাঁর দ্বিতীয় সন্তান (মেয়ে) মা ইউয়ানবাও এর নাম জানা গেলেও, তাঁর ৩য় সন্তানের নাম এখন পর্যন্ত অজানা!

জেরি মা ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কেলি ইউনিভার্সিটি থেকে পাশ করেছেন। এছাড়া আর তেমন কিছু তার ব্যাপারে জানা যায়নি।

তবে, জন্মের পর বেশ কিছু বছর জেরি মা পিতামাতাকে প্রায় কাছেই পাননি। জ্যাক ও ক্যাথি – দু’জনেই আলিবাবা নিয়ে মহা ব্যস্ত ছিলেন, এবং জেরিকে সপ্তাহে পাঁচদিন ডে কেয়ার সেন্টারে রাখা হত। জেরি এক সময়ে ভিডিও গেমে আসক্ত হয়ে পড়ে। তার ব্যবহারে চরম অসামাজিতা দেখা দেয়। এরপর জ্যাক ক্যাথিকে অনুরোধ করেন আলিবাবার জেনারেল ম্যানেজারের পদ ছেড়ে দিয়ে বাচ্চাদের দেখাশোনায় মন দিতে। প্রথমে রাজি না হলেও, সন্তানদের কথা ভেবে ক্যাথি তাঁর পদ থেকে সরে দাঁড়ান।

পুরস্কার ও স্বীকৃতি:
সফল উদ্যোক্তা, মানবসেবী, নেতা হিসেবে ব্যবসা ও মানবতায় অবদানের জন্য জ্যাক মা তাঁর জীবনে অনেক পুরস্কার ও স্বীকৃতি পেয়েছেন। যার মধ্যে প্রধান কয়েকটি এখানে দেয়া হল:

# ২০০৪ সালে চীনের জাতীয় টেলিভিশন তাঁকে বছরের সেরা ১০ অর্থনৈতিক ব্যক্তির একজন হিসেবে ঘোষণা করে। এটাই ছিল তাঁর প্রথম বড় স্বীকৃতি।

# ২০০৫ সালে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম তাঁকে একজন তরুন আন্তর্জাতিক নেতা হিসেবে নির্বাচন করে।

# ২০০৫ সালে প্রথমবারের মত তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাবান ২৫ জন ব্যবসায়িক ব্যক্তির তালিকায় স্থান পান।

# ২০০৮ সালে জ্যাক মা বিশ্বের সেরা ৩০জন সিইওর একজন হিসেবে স্বীকৃতি পান।

# ২০০৯ সালে টাইম ম্যাগাজিন তাঁকে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাবান ১০০ ব্যক্তির তালিকায় স্থান দেয়।

# ২০০৯ সালে জ্যাক মাকে চীনের সবচেয়ে সম্মানিত ১০জন উদ্যোক্তার একজন ঘোষণা করা হয়।

# একই বছর চীনের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন তাঁকে দশকের সেরা ব্যবসায়িক নেতার পুরস্কার প্রদান করে।

# ২০১৩ সালের নভেম্বরে হংকং ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এ্যান্ড টেকনোলজি জ্যাক মা কে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রী প্রদান করে।

# ২০১৪ সালে ফোর্বস ম্যাগাজিন তাঁকে বিশ্বের ৩০তম ক্ষমতাবান ব্যক্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত করে।

# ২০১৫ সালে এশিয়ান এ্যাওয়ার্ড কতৃপক্ষ জ্যাক মাকে বছরের সেরা উদ্যোক্তার পুরস্কার প্রদান করে।

# ২০১৭ সালে ফরচুন ম্যাগাজিন তাঁকে বর্তমান বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ৫০ নেতার মাঝে ২য় স্থান দেয়।

# ২০১৮ এর মে মাসে প্রযুক্তিতে অবদানের জন্য ইউনিভার্সিটি অব হংকং তাঁকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রী প্রদান করে।

জ্যাক মার জীবন কাহিনী থেকে নেয়া কিছু মজার তথ্য:
## ১৯৮৮ সাল থেকে জ্যাক মা ‘থাইচি’ নামক একটি মার্শাল আর্ট চর্চা করেন। বিদ্যাটি যে তিনি ভালই জানেন, তার প্রমাণ ২০১৭ সালের কুংফু সিনেমা Gong Shou Dao; জেট লি, এবং আই.পি ম্যান-খ্যাত ডনি ইয়েন এর মত বিশ্বসেরা মার্শাল আর্ট তারকাদের সাথে সমানে সমানে লড়তে দেখা যায় তাকে। বিশ্বাস না হলে সিনেমাটির নাম ইউটিউবে সার্চ দিলেই বুঝবেন।

## ২০১৪ সালে আলিবাবার বার্ষিক র‍্যালীতে কিম্ভূতকিমাকার সাজ নিয়ে জ্যাক মা ২০ হাজার কর্মীর সামনে ‘লায়ন কিং’ গানটির অংশ বিশেষ পারফর্ম করেন। ডেইলি মেইল তাঁকে ‘বিশ্বের সবচেয়ে উদ্ভট বিলিওনেয়ার’ এর খেতাব দেয়। পরবর্তীতে ২০১৭ সালে নিজের কর্মীদের সামনে তিনি মাইকেল জ্যাকসন সেজে স্টেজে উঠে নাচ গান করেন। এমনিতেই তো আর ‘ক্রেজি জ্যাক’ নাম হয় না।

## নিজের কোম্পানীর কর্মীদের জন্মদিন, বিয়ে ইত্যাদি অনুষ্ঠানে নিয়মিত হাজির থাকেন জ্যাক মা। কর্মীদের পাশে থাকার এই শিক্ষা তিনি ‘দি গডফাদার’ থেকে পেয়েছেন!

## জ্যাক মার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা একটি কাল্পনিক চরিত্র, ফরেস্ট গাম্প। টম হ্যাংকস অভিনীত বিখ্যাত চলচ্চিত্র ফরেস্ট গাম্প এর মূল চরিত্র ফরেস্ট কে তিনি বার বার ব্যর্থ হয়ে উঠে দাঁড়ানোর প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করেন।

## বিল ক্লিন্টন একটি টক শোতে চীনের মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলে জ্যাক মা তাঁর মুখের ওপর বলেন, “আপনাদের এত না ভাবলেও চলবে। আমেরিকানরা খরচ করতে পছন্দ করে বলে, তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা চোখে দেখা যায়। আমরা চীনারা খরচ দেখানোর বদলে টাকা জমাতে পছন্দ করি”।

পরিশিষ্ট: “জ্যাক মা – একটি ইতিহাস আর অনুপ্রেরণা”
বর্তমান বিশ্বে তরুন উদ্যোক্তাদের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণার নাম জ্যাক মা। তাঁর মত, বা তাঁরচেয়ে বড় সাফল্য হয়তো অনেকেই পেয়েছেন, কিন্তু চরম দরিদ্র অবস্থা থেকে শুধুমাত্র নিজের মনোবল আর আত্মবিশ্বাসকে পুঁজি করে, শত প্রতিকুলতার মাঝে উঠে আসার ক্ষেত্রে জ্যাক মা অনন্য।

আজকের পৃথিবীর কোটি কোটি তরুণের আইডল, ভালোবাসার মানুষ, কাছের মানুষ জ্যাক মা। হাজার কোটি ডলারের মালিক হয়েও যিনি নিজের শেকড় ভুলে যাননি। চালচলন, কথাবার্তায় আজও তিনি সেই “মা-ইউন”।

এত সাফল্যের পরও যাঁর পা মাটিতেই আছে। হাজার হাজার কর্মীকে উ‌ত্‍সাহ আর আনন্দ দিতে যিনি রীতিমত স‌ঙ সেজে মঞ্চে পারফর্ম করেন। নিজের দেশ আর তরুণদের উন্নয়নের জন্য নিজের হাতে গড়া প্রতিষ্ঠানের লোভনীয় পদ থেকে ইস্তফা দিতেও যাঁর বাধে না।

তাঁর জীবনী আমাদের শিক্ষা দেয়, পরিস্থিতি যত কঠিনই হোক, যত ব্যর্থতাই আসুক, মানুষ যদি নিজের বড় হওয়ার লক্ষ্যে অটল থাকে – তবে কিছুই অসম্ভব নয়।

হার্ভার্ডে ১০ বার প্রত্যাখ্যাত হয়ে জ্যাক মা নিজেকে বলেছিলেন: “পড়তে হয়তো পারলাম না, কিন্তু আমি একদিন ওখানে লেকচার দেব”

এখানেই জ্যাক মার মত মানুষের সাথে সাধারন মানুষের পার্থক্য। একারণেই তিনি একজন মানুষ হয়েও, একটি ইতিহাস হতে পেরেছেন।

স্বপ্ন দেখে ব্যর্থ হলে অন্যরা যখন স্বপ্ন দেখার সাহসই হারিয়ে ফেলে, জ্যাক মা এর মত মানুষেরা আরও বড় স্বপ্ন দেখেন। এই স্বপ্ন দেখে যেতে পারা, ও ব্যর্থতায় ভেঙে না পড়াই জ্যাক মার মত মানুষদের সাফল্যের গোপন সূত্র।

আমরা আশা করি জ্যাক মার জীবন কাহিনী আপনাকেও অনুপ্রাণিত করবে। তাহলেই আমাদের এত গবেষণা আর কষ্ট সার্থক হবে।

Back to top button