আন্তর্জাতিকনিউজ

তুরস্কে জারি এরদোয়ানবিরোধী বিক্ষোভ, পুলিশের হাতে গ্রেফতার ১৫০০ নাগরিক

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ও বিরোধী নেতা একরেম ইমামোগলুকে গ্রেফতারের পর দেশজুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে, যা এখনও অব্যাহত রয়েছে। ইস্তাম্বুলের মেয়র ইমামোগলুর গ্রেফতারের ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিক্ষুব্ধ জনতার সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনীর দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এই বিক্ষোভ দমনে তুরস্ক প্রশাসন ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করেছে, এবং এরই মধ্যে ১,৫০০-এর বেশি মানুষকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

গত সপ্তাহে দুর্নীতির অভিযোগে ইমামোগলুকে গ্রেফতার করা হলে তুরস্কে এক দশকেরও বেশি সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বড় বিক্ষোভের সূচনা হয়। বিরোধী দল রিপাবলিকান পিপলস পার্টির (সিএইচপি) সমর্থকরা এই গ্রেফতারিকে আইনের শাসনের স্পষ্ট লঙ্ঘন হিসেবে দেখছেন। তারা মনে করেন, এটি এরদোয়ান সরকারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অংশ, যার লক্ষ্য ২০২৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ইমামোগলুকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরিয়ে দেওয়া।

সংঘর্ষ ও নিরাপত্তা বাহিনীর কঠোরতা

বিক্ষোভকারীদের ওপর নিরাপত্তা বাহিনী জলকামান, মরিচের স্প্রে এবং রাবার বুলেট ব্যবহার করেছে। ইস্তাম্বুল, আঙ্কারা ও ইজমিরের মতো বড় শহরগুলোতে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ তীব্র আকার ধারণ করেছে। এই কঠোর পদক্ষেপের জন্য ইউরোপীয় কাউন্সিল তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। এক বিবৃতিতে তারা বলেছে, “ইমামোগলুর গ্রেফতারি এবং বিক্ষোভ দমনে অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ তুরস্কের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি হুমকি।” এদিকে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সতর্ক করে বলেছে, “এটি তুরস্কের গণতন্ত্রের জন্য একটি অন্ধকার সময়ের সূচনা।”

জনগণের ক্ষোভ ও ভোটের মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া

ইমামোগলুর গ্রেফতারের প্রতিবাদে বহু মানুষ রাস্তায় নেমেছেন এবং ব্যালট বাক্সের মাধ্যমেও তাঁদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। সিএইচপি দলের একটি প্রতীকী ভোটে প্রায় ১ কোটি ৫০ লাখ মানুষ ইমামোগলুকে আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রার্থী হিসেবে সমর্থন জানিয়েছেন। দলটির নেতা ওজগুর ওজেল বলেছেন, “এই গ্রেফতারি জনগণের ভোটাধিকারের ওপর আঘাত। আমরা শান্তিপূর্ণভাবে এর বিরুদ্ধে লড়ব।”

এরদোয়ানের শাসন ও গণতন্ত্রের অবক্ষয়

রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান গত ২২ বছর ধরে তুরস্ক শাসন করছেন। তাঁর শাসনামলে দেশটির গণতান্ত্রিক ভিত্তি ক্রমাগত দুর্বল হয়ে পড়েছে। ২০১৭ সালে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে তিনি নিজের ক্ষমতা অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছেন। বর্তমানে তাঁর সরকার বিচার বিভাগ, নিরাপত্তা সংস্থা এবং প্রায় সব গণমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। এরদোয়ান একবার বলেছিলেন, “গণতন্ত্র হলো একটি ট্রাম; গন্তব্যে পৌঁছালে তা থেকে নেমে যেতে হয়।” তাঁর এই বক্তব্য অনেকের কাছে তাঁকে একনায়ক হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

ক্ষমতার প্রথম দিকে এরদোয়ান অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে জনপ্রিয়তা অর্জন করলেও, পরবর্তী সময়ে তিনি বিরোধীদের দমন করতে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছেন। ২০১৬ সালের ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর তাঁর সরকার হাজার হাজার মানুষকে গ্রেফতার করেছে এবং বিরোধী কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করে দিয়েছে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ

ইমামোগলুর গ্রেফতারি এবং বিক্ষোভ দমনে সরকারের কঠোরতা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নজরে এসেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যরা তুরস্কের ইইউ সদস্যপদ প্রক্রিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। এদিকে, তুরস্কের অর্থনীতি ইতোমধ্যে চাপে রয়েছে। বিক্ষোভের কারণে তুর্কি লিরার মূল্য হ্রাস পেয়েছে, যা দেশটির অর্থনৈতিক সংকটকে আরও গভীর করতে পারে।

বিরোধী নেতারা জানিয়েছেন, তারা এই আন্দোলন চালিয়ে যাবেন এবং জনগণের ভোটাধিকার রক্ষায় শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ অব্যাহত রাখবেন। তবে এরদোয়ান সরকার কীভাবে এই সংকট মোকাবিলা করে, তা তুরস্কের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

Back to top button