অর্থনীতি

বিশেষ: চাকরি ছেড়ে ব্যবসা করতে চান, মাথায় রাখুন এই ১১টি বিষয়, তাহলেই মিলবে সাফল্য

প্রথমবারের মত চাকরি ছেড়ে দিয়ে ব্যবসায় পুরো সময় দেয়াটা অনেকটা পাহাড় থেকে লাফ দিয়ে নদীতে ঝাঁপ দেয়ার মত। বেঁচে গেলে দারুন একটি অভিজ্ঞতা। সবাই আপনাকে বাহবা দেবে, নিজেও বিরাট কিছু অর্জন করবেন। কিন্তু একটু এদিক সেদিক হলেই আর দেখতে হবে না!

অন্য যে কোনও কাজে নামার চেয়ে এই কাজে আপনাকে অনেক বেশি বিবেচনা করতে হবে।

ঝাঁপ দেয়ার আগে লাইফ জ্যাকেট ঠিক আছে কিনা দেখে নিতে হবে। আপনি যতই নিজের পথে যেতে চান না কেন, এটা অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে, আপনার আগের সম্পর্ক ও কানেকশন গুলো যেন কোনওভাবেই নষ্ট না হয়। সেই সাথে এটাও লক্ষ্য রাখতে হবে যে আপনি সঠিক সময়ে এই সিদ্ধান্তটি নিচ্ছেন। অন্যথায় “আম, ছালা – সবই যাবে”।

আপনাকে এমন একটি পয়েন্টে এসে কাজটি করতে হবে, যখন আপনি দুই জগতেরই সবচেয়ে ভাল দিকগুলো উপভোগ করছেন। অর্থা‌ত্‍ আপনার চাকরিও ভালো চলছে, সেই সাথে ব্যবসার অবস্থাও ভালোর দিকে।

একটি নতুন উদ্যোগের ফলাফল কেমন হবে তার অনেকটাই সেই ব্যবসায় পুরোপুরি নিয়োজিত হওয়ার আগেই বোঝা যায়। যদি অবস্থা ভালো মনে হয়, তবে আপনি আপনার চাকরির নিরাপত্তা ছেড়ে স্বাধীন ব্যবসার চ্যালেঞ্জে ঝাঁপিয়ে পড়তেই পারেন।

কিন্তু কিভাবে বুঝবেন যে এখন চাকরী ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি ব্যবসায় নামার সময় হয়েছে? – এক্ষেত্রে নিচের ১১টি বিষয় নিশ্চিত হয়ে তবেই চাকরী ছাড়ুন:

০১. একটি সত্যিকার ভালো পন্য বা সার্ভিস আপনার হাতে আছে
শুধুমাত্র একটি আইডিয়া, কিছু স্যাম্পল বা প্রটোটাইপ, সার্ভিস ডেমো – বা এই ধরনের জিনিসপত্র হাতে থাকাটা ব্যবসায় পুরোপুরি নামার জন্য যথেষ্ঠ নয়।

আপনার হাতে এমন কিছু থাকতে হবে যা সত্যিকার লাভজনক ব্যবসার সৃষ্টি করবে। আপনার কাছে যা-ই থাক না কেন, তার পেছনে একটি ভালো পরিকল্পনা ও প্রমাণিত বিজনেস মডেল থাকতে হবে। এবং এটা কতটা লাভজনক হতে পারে তার বাস্তব সম্মত তথ্য আপনার হাতে থাকতে হবে। শুধুমাত্র একটি আইডিয়া বা হঠা‌ত্‍ আসা সুযোগের ওপর ভিত্তি করে এতবড় ঝুঁকি নেয়া আজকের দিনে বুদ্ধিমানের কাজ নয়।

আপনাকে এক্সপেরিমেন্ট করে দেখতে হবে আপনার হাতে যে পন্য বা সেবা আছে, তা বাজারে সত্যিই চলছে; এবং তা থেকে আপনার লাভ আসার পাশাপাশি আবার বিনিয়োগ করার মত যথেষ্ঠ অর্থ আসছে।

এই ব্যাপারে যতক্ষণ না নিশ্চিত হতে পারছেন – ততক্ষণ এতবড় ঝুঁকির পথে পা বাড়াবেন না।

০২. আপনার সত্যিকার ক্রেতা সৃস্টি হয়েছে
আপনার পরিবার ও বন্ধুবান্ধব কখনওই আপনার সত্যিকার ক্রেতা বা গ্রাহক নয়। আপনি যদি একটি অনলাইন ফ্যাশন স্টোর খোলেন, এবং তার গ্রাহক যদি হয় শুধুমাত্র আপনার পরিচিত মানুষ আর আপনার ব্যক্তিগত ফেসবুক বন্ধুরা – তবে বলতেই হচ্ছে, আপনি এখনও কোনও ‘সত্যিকার’ ক্রেতা পাননি। আর এই অবস্থায় সবকিছু বাদ দিয়ে সেই ব্যবসার পেছনে লাগাটা মোটেও ভালো কিছু নয়।

আপনার টার্গেট কাস্টোমার, সাধারন ভোক্তা, পাইকার, খুচরা বিক্রেতা – যে-ই হোক না কেন, আপনার পরিচিত গন্ডির বাইরের মানুষ যতক্ষণ আপনার পন্য বা সার্ভিস না নিচ্ছে – ততক্ষণ বলা যাবে না যে আপনার সত্যিকার ক্রেতা আছে। শুধু সম্পর্কের খাতিরে মানুষ খুব বেশিদিন কারও কাছ থেকে পন্য বা সেবা নেয় না – যদি না সেটা আসলেই ভালো কিছু হয়। আর আপনি আসলেই ভালো পন্য বা সেবা সৃষ্টি করছেন কিনা, তা নিশ্চিত হবেন তখনই, যখন সাধারন ক্রেতারা আপনার থেকে পন্য বা সেবা নেয়া শুরু করবে।

০৩. দীর্ঘ সময় ব্যবসা চালিয়ে নেয়ার মত মূলধন আপনার কাছে জমা আছে
এক্সপেরিমেন্ট করে আপনি হয়তো বুঝতে পেরেছেন আপনার ব্যবসা ভবিষ্যতে ভালোই চলবে, এবং আপনার সত্যিকার ক্রেতার সংখ্যাও একটু একটু করে বাড়ছে। কিন্তু একটি ব্যবসা সত্যিকারের ‘রানিং’ হতে ও নিয়মিত লাভ উঠে আসতে ২ থেকে ৩ বছর পর্যন্ত লেগে যেতে পারে।

এর মানে হচ্ছে, আপনার ব্যবসা হয়তো ভালো চলছে, কিন্তু যতটা প্রয়োজন, ততটা অর্থ এখনও ব্যবসা থেকে আসছে না – যা দিয়ে আপনি ‘মাছের তেলে মাছ ভাজার’ মত করে ব্যবসার লাভ থেকেই ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করতে পারছেন। এই পর্যায়ে আসার আগে ব্যবসার মালিকের ব্যবসার টাকা থেকে দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটানো ব্যবসার জন্য খারাপ। কাজেই যতদিন না ব্যবসার টাকা থেকে ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করতে পারছেন, এবং দীর্ঘ সময় ব্যবসা চালিয়ে নেয়ার মত মূলধন আপনার একাউন্টে জমা হচ্ছে – ততদিন পুরোপুরি ঝুঁকি না নেয়াই ভালো।

০৪. চাকরির চেয়ে ব্যবসাটি বেশি উপভোগ করছেন
সব উদ্যোক্তাই যে তাদের চাকরিকে অপছন্দ করেন তা কিন্তু নয়। ভূমিকায় বলা আশরাফ সাহেবের কথাই ধরা যাক। টেক্সটাইল মেশিনারিজ মার্কেটিং করাটা শুধু তাঁর চাকরী নয়, এটা তাঁর প্যাশন। সেইজন্যেই তিনি এটাকেই ব্যবসা হিসেবে বেছে নিতে চাচ্ছেন। চাকরিরত অবস্থায় তিনি যে কাজ করবেন, ব্যবসাতেও প্রায় সেই একই কাজ করবেন। এবং কাজটিকে তিনি যথেষ্ঠ উপভোগ করেন।

একারণে, যাঁরা চাকরিতে নিজের কাজ পছন্দ করেন না, তাঁদের চেয়ে যাঁরা চাকরিতেও নিজের কাজ উপভোগ করেন – তাঁদের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এবং ব্যবসায়ের প্রথম অবস্থায় হয়তো কাজগুলো চাকরির প্রতিষ্ঠানের মত এতটা সহজ ও স্বাচ্ছন্দ্য হয় না। কাজেই চাকরির কাজকেই বেশি উপভোগ্য মনে হওয়া স্বাভাবিক।

কিন্তু ব্যবসার চ্যালেঞ্জটি চাকরিতে নেই। এবং একজন সত্যিকার উদ্যোক্তা এই চ্যালেঞ্জটি উপভোগ করেন। তাঁর কাছে এটি অশান্তির বিষয় হয়ে দাঁড়ায় না।

তবে এই পর্যায়ে পৌঁছতে কিছু কিছু উদ্যোক্তার কিছুটা সময় লেগে যায়। অনেক সময়েই জেদের বশে এবং লক্ষ্য পূরণের তাগিদে অনেকে ব্যবসার কাজ করে যেতে থাকেন – সেই সাথে তাঁরা নিজেদের চাকরিও উপভোগ করেন। এতে দোষের কিছু নেই, একটা সময়ে গিয়ে প্রায় সব উদ্যোক্তাই ব্যবসার চ্যালেঞ্জকে উপভোগ করতে শুরু করেন। অথবা ব্যবসা একটি ভালো পর্যায়ে চলে এলেও এটা ঘটে। আপনার ক্ষেত্রে যেটাই হোক না কেন, আপনি নিশ্চিত হয়ে নিন যে আপনি ব্যবসা করাকে পুরোপুরি উপভোগ করছেন। এবং তারপরই চাকরি ছাড়ুন। অন্যথায় কাজ উপভোগ করতে না পারলে আপনার মনে আফসোস হবে, এবং এতে ব্যবসায় আপনি পূর্ণ মনযোগ দিতে পারবেন না। দিন শেষে যা ব্যবসার জন্য ক্ষতিকর।

মনে রাখবেন, ব্যবসার মালিকের মনোভাব তার সহযোগীদের ওপর দারুন প্রভাব ফেলে। আপনি যদি আপনার কাজ উপভোগ না করেন, তবে অন্যদেরও সেই অবস্থা হবে।

০৫. নিশ্চিত হোন যে আপনার পেছনে কোনও বড় প্রতিযোগী লাগেনি
আপনি যদি চাকরিজীবি অবস্থা থেকে ব্যবসায়ে নামার পরিকল্পনা করেন, তবে ধরে নেয়া যায় বর্তমানে আর্থিক দিক দিয়ে আপনার তেমন একটা শক্ত অবস্থান নেই (যদি না আপনার পেছনে এক বা একাধিক বাঘা ইনভেস্টর থাকে)। এই ক্ষেত্রে আপনাকে একটু সাবধানে পা ফেলতে হবে, বিশেষ করে আপনি যদি দারুন প্রতিযোগীতাপূর্ণ কোনও ব্যবসায় নামতে যান।

আপনি যদি একদম ছোট থেকে শুরু করেন, আপনার পন্য বা সেবা প্রস্তুত করতে যে পরিমান খরচ হয়, বড় প্রতিষ্ঠানগুলো তারচেয়ে অনেক কম খরচে তা প্রস্তুত করতে পারে।

প্রাচীন যুগে দাসমালিকরা দাসদের খাটিয়ে অনেক কম খরচে তাদের পন্য তৈরী করত। অন্যদিকে সাধারন কৃষক ও কারিগরদের সেই একই পন্য প্রস্তুত করতে অনেকটা বেশি খরচ পড়ত। এর ফলে, ধনী দাসমালিকরা কৃষক ও কারিগরদের চেয়ে কম মূল্যে বাজারে পন্য ছাড়তে পারত, যার ফলে কৃষক ও কারিগর শ্রেনী তাদের পন্যের বাজার পেত না।

প্রাচীন গ্রীসে বহু কৃষক ও কারিগর তাদের কারবার গুটিয়ে সেনাবাহিনী বা অন্য চাকরি করতে বাধ্য হত।

বর্তমানে দাস প্রথা না থাকলেও, এই একই পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠান তাদের একচেটিয়া ব্যবসা টিঁকিয়ে রাখার পাশাপাশি নতুনদের মাথা তুলে দাঁড়াতে দেয় না।

অনেক সময়ে নতুন প্রতিযোগীদের বাজার থেকে তাড়াতে বড় কর্পোরেশন গুলো রীতিমত লস দিয়ে তাদের পন্য বিক্রী করে। তাদের অন্যান্য অনেক পন্য বাজারে থাকার কারণে এই লস তারা পুষিয়ে নিতে পারে। কিন্তু নতুন উদ্যোক্তাদের বেশিরভাগের এই সুবিধা না থাকার কারণে তারা প্রতিযোগীতায় টিঁকতে পারে না।

ব্যবসায় পূর্ণ ভাবে নামার আগে তাই নিশ্চিত হয়ে নিন, আপনার সাথেও এমন হওয়ার সম্ভাবনা আছে কি না। তাহলে ব্যবসার ধরন বা পরিকল্পনায় বদল আনুন। নিরবে বেড়ে ওঠার চেষ্টা করুন। প্রয়োজনে মার্কেট ছোট করে আনুন। কারণ, নতুন উদ্যোক্তা হিসেবে বড় কর্পোরেশনের রোষানলে পড়াটা বেশ বিপজ্জনক। এই ঝুঁকিকে একদম কম করে তারপরই ব্যবসায় পুরো সময় দিন।

Back to top button