অর্থনীতি

বিশেষ: কিনেছিলেন লোকসানে চলা কোম্পানি, নিজবুদ্ধিতে আজ কোটি কোটি টাকার মালিক

কিছু মানুষের হাতে নাকি জাদু আছে। তাঁরা যাতেই হাত দেন, তা সোনা হয়ে যায়। ওয়ারেন বাফেট এর জীবনী আসলে সেই কথাকেই প্রমাণ করে।

পৃথিবীর সর্বকালের সেরা ইনভেস্টর ও উদ্যোক্তাদের একজন তিনি। জেদের বশে লোকসানের মুখে বন্ধ হতে যাওয়া বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ে কিনে নিয়ে তাকে পৃথিবীর সেরা ১০টি কোম্পানীর একটি বানিয়েছেন।

বিশ্ব ইতিহাসে শেয়ার প্রতি সর্বোচ্চ মূল্য ওয়ারেন বাফেটের কোম্পানীর। প্রতিটি ক্লাস ‘এ’ শেয়ারের মূল্য ৩ লাখ ডলারের বেশি!

ডেইরি কুইন, ইউনাইটেড এয়ারলাইনস, ইউএস এয়ারলাইনস, কোকাকোলা (৯.৪% শেয়ার), ব্যাংক অব আমেরিকা (৬.৮% ), এ্যাপল (৫.২২%), আমেরিকান এক্সপ্রেস (১৭.৬%) আইবিএম (৮ কোটি ১০ লাখ শেয়ার) – সহ এমন বহু কোম্পানীর কলকাঠি নাড়ার মত অংশীদারিত্ব আছে তাঁর ও তাঁর কোম্পানীর।

২০১৩ সালে তাঁর দৈনিক আয় ছিল ৩৭ মিলিয়ন বা ৩ কোটি ৭০ লাখ ডলার। বর্তমানে তাঁর মোট সম্পদ ৯০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। জ্যাক মা, ইলন মাস্ক এর মত বিশ্বখ্যাত উদ্যোক্তাদের চেয়ে এই সম্পদ প্রায় দ্বিগুণ।

প্রশ্ন জাগতেই পারে, এত বিশাল সাফল্য একজন উদ্যোক্তা কিভাবে পেলেন? এই পথই বা কতটা কঠিন ছিল?

চলুন জেনে নিই ওয়ারেন বাফেট এর জীবন কাহিনী থেকে:

১৯৩০ সালে আমেরিকার নাব্রাসকা প্রদেশের ওমাহায় স্টক ব্রোকার (পরবর্তীতে কংগ্রেস ম্যান) হাওয়ার্ড বাফেট ও লেইলা বাফেট এর ঘরে জন্ম নেন তাঁদের এক মাত্র পুত্র ওয়ারেন বাফেট। ৩ ভাইবোনের মাঝে ওয়ারেন ছিলেন দ্বিতীয়।

ওয়ারেন বাফেট কাহিনী
[বালক ওয়ারেন বাফেট]
ওয়ারেন বাফেটের প্রথম স্কুল ছিল, ওমাহার ‘রোজ এলিমেন্টারি স্কুল’। যখন ওয়ারেন বাফেটের বয়স ১২ বছর, তখন তাঁর বাবা হাওয়ার্ড নাব্রাসকার কংগ্রেসম্যান নির্বাচিত হন। কংগ্রেস ম্যান আমাদের দেশের সংসদ সদস্যের মত একটি পদ। মূলত তাঁদের ভোটেই আইস পাশ হয়। হাওয়ার্ড বাফেট পর পর ৪বার এই পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন।

প্রথমবার নির্বাচিত হয়ে হাওয়ার্ড তাঁর পরিবার সহ ওয়াশিংটন ডিসি তে চলে আসেন, এবং ওয়ারেন প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে সেখানেই এ্যালিস ডেল জুনিয়র হাইস্কুল এ ভর্তি হন। পরবর্তীতে ১৯৪৭ সালে তিনি উডরো উইলসন হাইস্কুল থেকে স্কুল গ্রাজুয়েট হিসেবে বের হন। স্কুল ইয়ার বুকে তাঁর ছবির নিচে লেখা ছিল “ছেলেটা অংক পছন্দ করে, ভবিষ্যতে একজন স্টক ব্রোকার হবে”

স্কুলে পড়ার সময়েই বাফেট ও তাঁর এক বন্ধু মিলে ২৫ ডলার দিয়ে একটি স্পিনবল মেশিন কিনে এক নাপিতের দোকানের পাশে স্থাপন করেন। টাকার বিনিময়ে অনেকেই এই খেলা খেলে সময় কাটাতেন। পরে সেই মেশিনের লাভ থেকে তাঁরা আরও দুইটি মেশিন কিনে ফেলেন। ব্যবসা জমে উঠলে তাঁরা পুরো ব্যবসাটি ১২০০ ডলারে বিক্রী করে দেন। মাত্র ৭৫ ডলার বিনিয়োগ করে ১২০০ ডলার – সাথে ব্যবসার লাভ তো ছিলই! বালক বয়স থেকেই এমন ব্যবসার মাথা ছিল ওয়ারেন বাফেটের।

স্পিনবল মেশিনের ব্যবসা ছাড়াও ওয়ারেন স্কুলে পড়ার সময়েই চুইং গাম বিক্রী, কোকাকোলার বোতল বিক্রী, বাসায় বাসায় পত্রিকা বিলি করা- ইত্যাদি অনেক কাজ করেই টাকা রোজগার করার চেষ্টা করতেন। নিজের দাদুর দোকান থেকে চিপস কিনে কিছুদূর হেঁট দিয়ে ৫ সেন্ট লাভে বিক্রী করার ঘটনাও তিনি ঘটিয়েছিলেন বাল্যকালে।

ওয়ারেন বাফেটের জীবনী
[হাইস্কুল পড়ুয়া ওয়ারেন বাফেট]
ছোটবেলা থেকে টাকা কামানোর প্রতি এই ঝোঁকের কারণ তিনি ৭ বছর বয়সে ওমাহা পাবলিক লাইব্রেরিতে একটি বই পড়েছিলেন। বইটির নাম “One Thousand Ways to Make $1000” – এরপর থেকেই মূলত তাঁর মাথায় উদ্যোক্তা হওয়ার ঝোঁক চাপে।

স্কুলে তাঁকে অংকের জিনিয়াস বলা হত, কারণ তিনি বিশাল বিশাল সব অংকের হিসাব হাতেই করতে পারতেন – অন্যরা যা ক্যালকুলেটর ছাড়া চিন্তাও করতে পারত না।

১০ বছর বয়সে তিনি নিউ ইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জ পরিদর্শন করেন। ১১ বছর বয়সে নিজের জন্য ৩টি ও তাঁর বোন ডরিস এর জন্য ৩টি “সিটিজ সার্ভিস” এর শেয়ার কেনেন। এবং কিছু লাভ করেন।

১৫ বছর বয়সেই ওয়ারেন বাফেট এর মাসিক আয় ছিল প্রায় ২০০ ডলার। সময়টা তখন ১৯৪৫। সেই সময়ে হাজারখানেক ডলার হলে বছর চলে যেত। বাফেট হাইস্কুলে পড়ার সময়েই বাবার ব্যবসায় তাঁর নিজের জমানো ১২০০ ডলার বিনিয়োগ করে বাবার সাথে পার্টনারশিপে ৪০ একরের একটি কৃষি খামার কেনেন!

হাইস্কুল শেষ করেই বাফেট সিদ্ধান্ত নেন, তিনি আর পড়াশুনা করবেন না। পুরোপুরি ব্যবসায় মনযোগ দেবেন।

কিন্তু তাঁরা বাবা এতে বাধা দেন, ফলে ১৯৪৭ সালে বাফেট ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভেনিয়ায় ভর্তি হন। সেখানে দুই বছর পড়ে ইউনিভার্সিটি অব নাব্রাসকায় ট্রান্সফার হন, এবং ১৯ বছর বয়সে সেখান থেকে ব্যবসা প্রশাসনে বিএসসি শেষ করেন।

এরপর হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলে ঢোকার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে তিনি কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির অধীন কলম্বিয়া বিজনেস স্কুল এ ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৯৫১ সালে অর্থনীতিতে মাস্টার্স করে বের হন।

কলেজ থেকে পাশ করে বের হওয়ার আগেই তাঁর হাতে ৯৮০০ ডলার জমা ছিল। আজকের দিনের হিসাবে তা ১০১০০০ ডলার। বাংলা টাকায় প্রায় ৮৫ লাখ টাকা!

ব্যবসা ও ক্যারিয়ার:
বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ে এর আগে:

কলেজ থেকে বের হয়ে তিনি ১৯৫১ থেকে ১৯৫৪ পর্যন্ত Buffett-Falk & Co. এ একজন ইনভেস্টমেন্ট সেলস ম্যান হিসেবে কাজ করেন। ১৯৫৪ থেকে ৫৬ পর্যন্ত Graham-Newman Corp. এ একজন সিকিউরিটি এ্যানালিস্ট হিসেবে কাজ করেন। ১৯৫৬ থেকে ১৯৬৯ পর্যন্ত তিনি Buffett Partnership, Ltd. এর একজন জেনারেল পার্টনার হিসেবে কাজ করেন। অবশেষে ১৯৭০ সাল থেকে বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ে এর চেয়ারম্যান ও সিইও হন।

১৯৫২ সালের এপ্রিলে বাফেট জানতে পারেন তাঁর গুরু বেনজামিন গ্রাহাম GEICO ইন্সুরেন্স এর বোর্ড অব ডিরেক্টরদের একজন। শোনা মাত্র তিনি এক শনিবারে ওয়াশিংটনের ট্রেন ধরে গেইকোর হেডকোয়ার্টারে গিয়ে দরজা না খোলা পর্যন্ত কড়া নাড়তে থাকেন। তাঁর সাথে প্রথমেই সেখানকার এক পরিচ্ছন্নতা কর্মীর দেখা হয়, এবং তিনি কোম্পানীর ভাইস প্রেসিডেন্ট লোরমির ডেভিসন এর সাথে সাক্ষাতের সুযোগ পান।

পরবর্তীতে এই ব্যক্তি বাফেটের অন্তরঙ্গ বন্ধু ও উ‌ত্‍সাহ দাতা হয়ে ওঠেন। ডেভিসন পরে বলেছিলেন, বাফেটের সাথে ১৫ মিনিট কথা বলার পরই তিনি বুঝেছিলেন, এই ছেলে একজন ‘অন্যরকমের অসাধারণ’ ব্যক্তি।

বাফেট ওয়াল স্ট্রিটে কাজ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর বাবা হাওয়ার্ড, এবং তাঁর গুরু বেন গ্রাহাম – দু’জনেই তাঁকে একাজ করতে মানা করেন। তিনি এমনকি গ্রাহামের জন্য বিনামূল্যে কাজ করারও প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু গ্রাহাম তারপরও তাঁকে না করে দেন।

এরপর বাফেট আবার তাঁর বাড়ি ওমাহাতে ফিরে আসেন, এবং স্টক ব্রোকার হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি ডেল কার্নেগী এর পাবলিক স্পিকিং কোর্স এ ভর্তি হন।

পাবলিক স্পিকিং কোর্স থেকে পাওয়া আত্মবিশ্বাস ও ব্যবসা থেকে পাওয়া জ্ঞান কাজে লাগিয়ে তিনি ইউনিভার্সিটি অব নাব্রাসকায় “Investment Principles” বিষয়ক একটি নৈশ ক্লাসে শিক্ষা দেয়া শুরু করেন। মজার ব্যাপার, তাঁর বেশিরভাগ ছাত্রের বয়স তাঁর দ্বিগুণেরও বেশি ছিল!

ওয়ারেন বাফেট কাহিনী
[ক্লাসে লেকচার দিচ্ছেন তরুন ওয়ারেন]
এই সময়ে তিনি একটি গ্যাস স্টেশন কিনে ব্যবসার চেষ্টা করেন, তবে তাঁর সেই উদ্যোগ পুরোপুরি ব্যর্থ হয়।
১৯৫৪ সালে বাফেটের বিরাট এক স্বপ্ন পূরণ হয়। বেনজামিন গ্রাহাম নিজেই তাঁকে একটি ব্যবসায়ে কাজ করার প্রস্তাব দেন। তাঁর বা‌ত্‍সরিক বেতন ধরা হয় ১২০০০ ডলার (বর্তমান হিসাবে প্রায় ১,০৯,০০০ ডলার)। এই চাকরির ফলে গুরুর খুব কাছে থেকে কাজ করার ও শেখার সুযোগ হয় তাঁর।

বেনজামিন গ্রাহাম দারুন কড়া একজন বস ছিলেন, কিন্তু তাঁর কাছ থেকে বাফেট জীবনের সেরা লিসন গুলোর অনেকটাই পেয়েছিলেন। ১৯৫৬ সালে গ্রাহাম অবসর নেন। সেই সাথে বাফেটও তাঁর পদ ছেড়ে দেন, এবং নিজের জমানো ১৭৪,০০০ ডলার (বর্তমানে প্রায় ১.৫৭ মিলিয়ন) দিয়ে নিজের ফার্ম বাফেট পার্টনারশিপ লিমিটেড শুরু করেন।

১৯৫৭ সালের মধ্যেই বাফেট ৩টি ব্যবসার অংশীদার হয়ে যান। ১৯৫৯ সালের মধ্যেই তাঁর কোম্পানী ৬টি পার্টনারশিপে রূপ নেয়, এবং পরের বছর তা ৭টি পার্টনারশিপে দাঁড়ায়। ১৯৬২ সালের মধ্যে তিনি একজন মিলিওনেয়ার হয়ে যান।

বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ে অধ্যায়:

১৮৩৯ সালে অলিভার চেস একটি টেক্সটাইল প্রতিষ্ঠা করেন। নাম ছিল ‘ভ্যালি ফলস কোম্পানী’। ১৯২৯ সালে ভ্যালি ফলস ১৮৩৯ সালে প্রতিষ্ঠিত বার্কশায়ার কটন ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানীর সাথে এক হয়ে যায়। দুই কোম্পানী মিলে নাম হয় “বার্কশায়ার ফাইন স্পিনিং এ্যাসোসিয়েটস”।

১৯৫৫ সালে বার্কশায়ার ফাইন স্পিনিং এ্যাসোসিয়েটস ১৮৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত “হ্যাথাওয়ে ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানী” নামের প্রতিষ্ঠানটির সাথে এক হয়ে যায়।

প্রথম দিকে হ্যাথাওয়ে ম্যানুফ্যাকচারিং বেশ লাভজনক একটি টেক্সটাইল কোম্পানী ছিল। কিন্তু ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর থেকে পুরো টেক্সটাইল ইনডাস্ট্রির খারাপ অবস্থার প্রভাব এর ওপর পড়তে থাকে। ফলে একটা সময়ে এটি বার্কশায়ার স্পিনিং এ্যাসোসিয়েটস এর সাথে এক হতে বাধ্য হয়। নতুন কোম্পানীটির নাম হয় “বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ে”।

বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ে
[প্রথম যুগের বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ে হেডকোয়ার্টার]
১৯৫৫ সালে বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ে প্রতিষ্ঠার পর ১৫টি টেক্সটাইল ফ্যাক্টরিতে ১২০০০ কর্মী নিয়ে কাজ চলতে থাকে। এবং বছরে প্রায় ১২০ মিলিয়ন ডলার লাভ হতে থাকে।

কিন্তু ৬০ এর দশক শুরু হতে হতে ১৫টির মাঝে ৭টি মিল বন্ধ হয়ে যায়। সেই সাথে বিপুল পরিমান কর্মীও ছাঁটাই হয়। – এই সময়েই ইনভেস্টিং জিনিয়াস ওয়ারেন বাফেট মঞ্চে প্রবেশ করেন।

১৯৬২ সালে বাফেট বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ে এর স্টক কেনা শুরু করেন। কারণ তিনি দেখেছিলেন, কোম্পানীটির একটি করে মিল বন্ধ হয়, শেয়ারের দাম পড়ে যায়। তিনি লক্ষ্য করেন, আমেরিকার টেক্সটাইল ব্যবসা একদমই পড়ে যাচ্ছে, এবং এর সাথে জড়িত কোম্পানীগুলোর আর্থিক অবস্থা ক্রমেই খারাপ হতে থাকবে। কিন্তু এমন পুরনো ঐতিহ্যবাহী কোম্পানীর নামও অনেক কিছু।

এভাবে কিনতে কিনতে কোম্পানীর উল্লেখযোগ্য পরিমান শেয়ার বাফেটের হাতে চলে যায়। এবং কোম্পানীর মালিক পক্ষ নড়েচড়ে বসে। কারণ, এত শেয়ার একজনের হাতে থাকলে তা বিপদের কারণ হতে পারে।

১৯৬৪ সালে কোম্পানীর চেয়ারম্যান সিবারি স্ট্যানটন বাফেটকে কফি খাওয়ার দাওয়াত দেন, এবং শেয়ার প্রতি ১১​১/২ ডলারে বাফেটের সব শেয়ার কিনে নেয়ার মৌখিক প্রস্তাব দেন।

লাভজনক হওয়ায় বাফেট সেই প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান। কিন্তু কাগজ কলমে টেন্ডার সই হওয়ার সময়ে বাফেট দেখেন, চুক্তিমত শেয়ার প্রতি ১১​১/২ ডলার মূল্যের জায়গায় ১১​৩/৮ মূল্য ধরা হয়েছে।

পরে বাফেটের কাছে জানা যায়, এটিকে তাঁর প্রতারণা মনে হয়। রেগে গিয়ে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেন যে তিনি শেয়ার তো বিক্রী করবেনই না, এর বদলে আরও শেয়ার কিনে বার্কশায়ার হ্যাথাওয়েকে নিয়ন্ত্রণ করবেন, এবং স্ট্যানটনকে তার নিজের কোম্পানী থেকেই বের করে দেবেন।

তিনি নামে-বেনামে আরও শেয়ার কেনা শুরু করলেন, এবং একটা সময়ে গিয়ে তাঁর হাতে এত শেয়ার জমে গেল যে তিনি কোম্পানীর সবচেয়ে বড় শেয়ার হোল্ডার হয়ে বসলেন। এবং প্রতিজ্ঞামত স্ট্যানটেনকে কোম্পানী থেকে বের করে দিয়ে নিজের মনোনীত একজনকে চেয়ারম্যান পদে বসান।

জেদের বশে কাজটি করার পর বাফেট তাঁর ভুল বুঝতে পারেন। তিনি আসলে একটি ব্যর্থ কোম্পানী কিনেছেন। যদিও কোম্পানীটিকে তিনি ইতিহাসের অন্যতম সফল একটি কোম্পানীতে পরিনত করেছেন, কিন্তু তাঁর ভাষ্যমতেই, এই ভুলটি না করে যদি তিনি সরাসরি ইন্সুরেন্স ও অন্যান্য ব্যবসায় বিনিয়োগ করতেন, তবে তিনি জীবনে আরও কয়েকশ গুণ বেশি সম্পদ অর্জন করতে পারতেন। অর্থা‌ত্‍ তাঁর সর্বকালের সেরা ধনী হওয়ার একটা সম্ভাবনা ছিল!

যাই হোক, প্রথম দিকে বাফেট বার্কশায়ারের মূল ব্যবসা টেক্সটাইল চালালেন। কিন্তু কোনও উন্নতি না হওয়ায় ১৯৬৭ এর দিকে তিনি তাঁর আগ্রহের ব্যবসা ইন্সুরেন্স এ মনোযোগ দিতে শুরু করেন। এছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রেও বিনিয়োগ করা শুরু করেন।

১৯৭৯ সালে বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ে শেয়ার প্রতি ৭৭৫ ডলারে বছর শুরু করে, এবং ১৩১০ ডলারে শেষ করে। এর ফলে বাফেটের মোট ব্যক্তিগত সম্পদ দাঁড়ায় ৬২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে।

১৯৮৮ সালে বাফেট কোকাকোলা কোম্পানীর শেয়ার কিনতে শুরু করেন, এবং ধীরে ধীরে ১.০২ বিলিয়ন ডলারের শেয়ার কিনে ফেলেন, যা কোম্পানীটির প্রায় ৭% মালিকানা।

এভাবেই ধীরে ধীরে ইন্সুরেন্স থেকে এয়ারলাইন, রেল, কয়লা, খাদ্য, পানীয় – সব দিকেই বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ে, অর্থা‌ত্‍ ওয়ারেন বাফেট এর হাত প্রসারিত হতে থাকে। এর মধ্যে আমেরিকা ও বিশ্বের বেশ কয়েকটি প্রথম শ্রেণীর কোম্পানীতে বিনিয়োগ করাও আছে। ১৯৮৫ সালে বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ে এর শেষ টেক্সটাইল মিলটি বন্ধ হয়ে যায়।

কোম্পানীটির বর্তমান ভ্যালু ৩০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের কাছাকাছি। এছাড়া কোম্পানীর একাউন্টে জমা নগদ অর্থের পরিমান ১১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার!

১৯৬৫ সাল থেকে ওয়ারেন বাফেট প্রতি বছর শেয়ার হোল্ডারদের উদ্দেশ্যে একটি চিঠি প্রকাশ করেন। গড়ে চিঠিগুলোর ব্যাপ্তি হয় ৩০ পৃষ্ঠার মত। কথিত আছে, এই চিঠির মাধ্যমেই পরবর্তী বছর কোম্পানী কিভাবে কাজ করবে, এবং এর অবস্থা কি দাঁড়াবে – তার ইঙ্গিত থাকে। ২০১৪ সালে বাফেটের বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ের মালিকানা গ্রহণের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ৫০টি চিঠি নিয়ে একটি বই প্রকাশ হয়। বইটি তরুণ উদ্যোক্তা, বিশেষ করে যারা ইনভেস্টর হতে চান, তাঁদের জন্য একটি অমূল্য জ্ঞানভান্ডার।

ব্যক্তিগত জীবন:

১৯৫২ সালে ওয়ারেন বাফেট সুসান থম্পসন নামে এক মহিলাকে বিয়ে করেন। পরের বছর তাঁদের প্রথম সন্তান সুসান এলিস বাফেট এর জন্ম হয়। ১৯৫৪ সালে ২য় সন্তান হাওয়ার্ড গ্রাহাম বাফেট জন্মগ্রহণ করেন। হাওয়ার্ড গ্রাহামের নাম রাখা হয়েছিল ওয়ারেনের বাবা হাওয়ার্ড ও গুরু বেনজামিন গ্রাহামের নামানুসারে। এর ৪ বছর পর ১৯৫৮ সালে সুসান ও ওয়ারেন বাফেটের ৩য় সন্তান পিটার এ্যান্ড্রু বাফেটের জন্ম হয়।

২০০৪ সালে সুসান বাফেট এর মৃত্যুর পর ২০০৬ সালে ওয়ারেন তাঁর দীর্ঘদিনের বন্ধু এ্যাস্ট্রিড মিনক্‌সকে বিয়ে করেন। বিয়ের সময়ে এ্যাস্ট্রিড এর বয়স ছিল ৬০ আর বাফেট বিয়ের উ‌ত্‍সবের পাশাপাশি তাঁর ৭৬তম জন্মদিনও উদযাপন করছিলেন। এ্যাস্ট্রিড, ওয়ারেন আর সুসানের মাঝে এতই নিবিড় সম্পর্ক ছিল যে, দীর্ঘদিন ধরে ক্রিসমাসে তাঁরা তিনজন একসাথে সাইন করে বন্ধু ও আত্মীয়দের ক্রিসমাস কার্ড পাঠাতেন!

গাড়ি, বাড়ি, শখ:

বিশ্বের সর্বকালের সেরা ধনীদের একজন হলেও ওয়ারেন বাফেট বলতে গেলে দারুন সাধারণ জীবনযাপন করেন। হলিউডের ধনাঢ্য মাল্টি মিলিয়নেয়ার তারকারা যখন তাদের চেহারার মত বাড়ির জৌলুস দেখাতে ব্যস্ত, তখন ওয়ারেন বাফেট তাঁর ১৯৫৮ সালে ৩১৫০০ ডলারে কেনা বাড়িতেই থাকেন। বর্তমানেও এই বাড়ির মূল্য ১ মিলিয়ন ডলারের কম! বিশ্বের সেরা ইনভেস্টরের ভাষায়, “এটা আমার জীবনের ৩য় সেরা বিনিয়োগ(!)”

নাব্রাসকার ওমাহায়, শান্ত প্রাকৃতিক পরিবেশের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা ৬৫৭০ স্কয়ার ফিটের বাড়িটিতে ৫টি বেডরুম আছে। বিবিসির এক সাংবাদিক তাঁকে একবার জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “কেন আপনি আরও দামী কোনও বাড়িতে উঠছেন না?” প্রবীন বিলিওনেয়ারের জবাব ছিল, “আমি এখানে সুখে আছি। অন্য কোথাও যদি এর চেয়ে বেশি শান্তি পাই, তবে সেখানে চলে যাব”।

গাড়ির ক্ষেত্রেও বাফেটকে ‘কৃপণ’ বলতে হবে। যেখানে মিলিয়নেয়ার হলেই মানুষ লক্ষ ডলারের মার্সিডিজ, ল্যাম্বারগিনি – ইত্যাদি বিলাসবহুল গাড়ি হাঁকিয়ে নিজের জৌলুস দেখাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে – সেখানে বাফেট ৪৫০০০ ডলার বাজার মূল্যের একটি ক্যাডিলাক XTS চালিয়েই সন্তুষ্ট। এই গাড়িটি তিনি ২০১৪ সালে মেয়ের জোরাজুরিতে কিনেছেন। এর আগে তিনি ক্যাডিলাক DTS এ চড়তেন। তাঁর মেয়ের এই গাড়ি পছন্দ না হওয়ায় তিনি মডেল বদলান। কিন্তু গাড়ির দাম ৫০০০০ পার করেনি। গাড়ি তিনি ব্যবহার করেন প্রয়োজনে, সম্পদের প্রদর্শনী করার জন্য নয়। ফোর্বস ম্যাগাজিনকে দেয়া এক সাক্ষা‌ত্‍কারে বাফেট একবার বলেছিলেন “আমি বছরে ৩৫০০ মাইলের বেশি ড্রাইভ করি না। তাই নতুন গাড়ি কিনতে আমার একটু সময় লাগে”

আসলে বড় বড় বিলিয়নেয়ার বা ব্যবসায়ীরা, টাকা দিয়ে সুখ কিনবেন বলে কাজ করেন না, তাঁরা কাজ করেন প্যাশন থেকে। সুখটা তাঁরা খুঁজে পান কাজের মাঝে, টাকা একটা বাড়তি পাওয়া। বাফেটের সাধারণ জীবনযাপনই তার প্রমাণ। তাঁর জনহিতকর কাজের ফিরিস্তি শুনলে ব্যাপারটা আপনার কাছে আরও পরিস্কার হয়ে যাবে।

Back to top button