অফবিট

বিশেষ: কম বয়সেই ধনী হওয়ার সেরা উপায়, সেরা বইটির থেকে জেনেনিন গুরুত্ত্বপূর্ন তথ্য

প্রথমেই বলে রাখি, এটি কোনও সস্তা দরের ইনফোমার্শাল বুক নয়, যেগুলো আপনাকে ৩০ দিনে/১ বছরে ধনী হওয়ার উপায় বলবে। এই বইটির লেখক নিজে ৩১ বছর বয়সে মিলিওনেয়ার হয়েছেন – কিন্তু তা হতে তাঁকে বহুদিন পরিশ্রম করতে হয়েছে আর বুদ্ধি খাটাতে হয়েছে – কিন্তু তিনি বুড়ো হওয়ার আগে মিলিওনেয়ার হতে পেরেছেন।

বেশিরভাগ মানুষই যেখানে বহু বছর পরিশ্রম করে টাকা জমিয়ে জমিয়ে শেষ বয়সে ধনী হয়ে আরামে জীবন কাটানোর পরিকল্পনা করে – লেখক সেখানে তরুণ বয়সেই ধনী হয়ে সেই ধন উপভোগ করার পদ্ধতি দেখাতে চেয়েছেন। বুক রিভিউটি পড়তে পড়তে আপনি এই ব্যাপারে আরও বিস্তারিত জানতে পারবেন।

বুক রিভিউটি বেশ দীর্ঘ কারণ, আমরা এই বইয়ের শিক্ষনীয় ব্যাপারগুলো যতটা সম্ভব বিস্তারিত তুলে ধরার চেষ্টা করেছি, যাতে মূল বইটি না পড়েও আপনি এর আইডিয়াগুলো যথেষ্ঠ ভালো করে আত্মস্থ করতে পারেন।

দি মিলিয়নেয়ার ফাস্টলেন এর লেখক:
দি মিলিওনেয়ার ফাস্টলেন এম জে ডিমার্কো এর লেখা একটি বেস্ট সেলিং ফাইনানশিয়াল সাকসেস বিষয়ক বই। লেখক ছাড়াও ডিমার্কোর আরও একটি পরিচয় – তিনি একজন সফল উদ্যোক্তা। বেশ কয়েকটি সফল ব্যবসা তাঁর হাত ধরে গড়ে উঠেছে। তিনি limos.com এর প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক সিইও।এই কোম্পানীটি তিনি মোট দুইবার বিক্রী করেন। প্রথমবার বিক্রী করার পর ক্রেতারা সেটি খুব ভালো মত চালাতে পারেনি। তিনি কম দামে আবার সেটি কেনেন। তারপর আবার বিশাল লাভে বিক্রী করেন। ২৬ বছর বয়সেও মায়ের সাথে বাস করা ডিমার্কো মাত্র ৩৩ বছর বয়সে মাল্টি মিলিওনেয়ার হয়ে যান।

ছোটবেলা থেকেই তাঁর স্বপ্ন ছিল তিনি একটি ল্যাম্বারগিনির মালিক হবেন। এবং তিনি কম বয়সেই বুঝতে পেরেছিলেন, ল্যাম্বরগিনির মালিক হতে হলে তাঁকে ব্যবসা করতে হবে। চাকরি করে এই জিনিসের মালিক হতে গেলে তাঁকে বুড়ো হয়ে যেতে হবে, যে বয়সে গাড়ির স্পিড তোলার মত জোশ আর তাঁর মাঝে থাকবে না।
চলার জন্য তাঁকে অবশ্য বেশ কিছু ছোট ছোট চাকরি করতে হয়েছে। এর মধ্যে একটা ছিল লিমুজিন গাড়ি চালানো। লিমু কেনার সামর্থ্য খুব কম লোকেরই হয়। বেশিরভাগই ভাড়ায় চালিত। এরকম এক যাত্রী তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, নিউ ইয়র্ক সিটিতে লিমুজিন কিভাবে পাওয়া যায়? – এই প্রশ্ন থেকেই তাঁর মাথায় লিমু ডট কম এর আইডিয়া এসেছিল। যারা লিমু খুঁজছেন, এবং যাঁরা ভাড়া দিতে চাইছেন – তাদের মধ্যে একটা যোগাযোগ ঘটিয়ে দিয়ে মাঝখান থেকে মুনাফা অর্জন করাই ছিল যার উদ্দেশ্য। – নিশ্চই উবারের কথা আপনার মাথায় আসছে? – আসলে লিমু ডট কম এর শুরুটা হয়েছিল সেই ২০০৭ সালে।

যাই হোক, লিমুর পর ডিমার্কো একে একে আরও কয়েকটি ব্যবসার সাথে জড়িত হন, এবং রীতিমত ধনী হয়ে ওঠেন। ল্যাম্বরগিনির স্বপ্ন তো পূরণ হয়েছেই – সাথে আরও অনেক কিছুই হয়েছে। চাইলে তিনি সারাজীবনে আর কোনও কাজ না করেও পায়ের উপর পা তুলে কাটিয়ে দিতে পারবেন।

এত কম বয়সে তাঁর এই সাফল্য আসলেও এর পেছনে ছিল অনেক দিনের সাধনা ও পরিশ্রম। তাঁর অভিজ্ঞতা ও মাইন্ডসেট কাজে লাগিয়ে যেন অন্যরাও ৬০ বছরে ব্যাঙ্কে মোটা অংকের টাকা জমানোর বদলে, ৪০ এর আগেই ধনী হতে পারে – তাই তিনি দি মিলিওনেয়ার ফাস্টলেন বইটি লিখেছেন। প্রকাশের পর থেকেই বইটির বিক্রী দেখার মত।

পরবর্তী অনেক তরুণ মিলিওনেয়ারই তাঁর বই থেকে উপকার পাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন।

মূল ধারণা:
কম বয়সে দ্রুত ধনী হওয়াই মূলত এই বইটির মূল কথা। তবে তিনি বার বার বলেছেন, কম বয়সে ধনী মানে রাতারাতি ধনী নয় – এর জন্য অবশ্যই আপনাকে কাঠখড় পোড়াতে হবে।

লেখক কম বয়সে ধনী হওয়ার মাইন্ডসেট ও উপায় বলার পাশাপাশি তিনি আগের যুগের একটি জনপ্রিয় ধারণাকে বাতিল করেছেন। ধারণাটি হল: “পড়াশুনায় ভালো রেজাল্ড করো, ভালো একটি চাকরিতে কঠোর পরিশ্রম করো, টাকা জমাও, শেষ বয়সে আরাম করো”

এই পুরাতন ধারণা থেকে বের হয়ে এসে লেখক নতুন যুগের সাথে তাল মিলিয়ে শেষ বয়সে আরাম করার বদলে, তরুণ বয়সেই মুক্ত হয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন। সেইসাথে, তাঁর জিনের জন্য যেসব মাইন্ডসেট কার্যকর ভূমিকা রেখেছে – সেগুলো বইয়ে বর্ণনা করেছেন – যেন নতুনরা সেখান থেকে শিখে নিজেদের জীবনে কাজে লাগাতে পারে।

দি মিলিওনেয়ার ফাস্টলেন বুক রিভিউ:
এম জে ডিমার্কোর বেস্ট সেলার বইটি মোট ৮টি মূল ভাগে বিভক্ত। চলুন প্রতিটি ভাগে লেখক কি বলেছেন – তার মূল আইডিয়াগুলো জেনে নেয়া যাক।

১ম ভাগ: উপলব্ধি
ডিমার্কো আমেরিকার শিকাগোর খুব সাধারণ একটি পরিবারে বেড়ে উঠেছিলেন। মোটাসোটা মার্কোর তেমন কোনও বন্ধু ছিল না। খেলাধুলায় ছিলেন একদমই খারাপ; পড়াশুনায়ও খুব একটা ভালো ছিলেন না। তাঁর দিন কাটতো টিভি দেখে আর ভিডিও গেম খেলে।

তবে সেই অল্প বয়সে ঘটা একটি ঘটনাই তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। আইসক্রিমের দোকানে যাওয়ার সময়ে তাঁর চোখে পড়ে ঝকঝকে একটি ল্যাম্বারগিনি কাউন্টাক। গাড়িটি দেখামাত্রই তিনি গাড়ির প্রেমে পড়ে যান। একটু পর তিনি গাড়ির মালিককে দেখতে পান। লোকটির বয়স আনুমানিক ২৫-২৬; পরনে ঢোলা ফ্লানেল শার্ট আর জিন্স প্যান্ট।

লোকটিকে দেখে তাঁর কোনওভাবেই মালিক বলে বিশ্বাস হচ্ছিল না। তিনি ধারণা করেছিলেন এমন একটি গাড়ির মালিক হবে বেশ বয়স্ক একজন লোক। সেই সময়ে তিনি শুনতেন – কম বয়সে বড়লোক হওয়াটা অসম্ভব ব্যাপার। সত্যিকার বড়লোক হতে হতে একজন মানুষের এত বয়স হয়ে যায় যে, তার সেই সৌভাগ্য উপভোগ করার বয়স থাকে না। এগুলো আসলে ধনী লোকটির উত্তরাধিকারীরা উপভোগ করে। ডিমার্কোর সন্দেহ হল, লোকটি আসলেই গাড়ির মালিক কি না। তবে সরাসরি জিজ্ঞেস করা অভদ্রতা হবে, তাই তিনি লোকটিকে প্রশ্ন করলেন, “আপনি কি কাজ করেন যে এত চম‌ত্‍কার একটি গাড়ি কিনতে পেরেছেন?”

ড্রাইভ করে চলে যাওয়ার আগে লোকটির এক কথায় জবাব ছিল, “আমি একজন আবিষ্কারক”। গাড়িটি লোকটি নিজের টাকায় কিনেছে – এই ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার পর থেকেই লেখক তাঁর জীবনের লক্ষ্য ঠিক করে ফেলেন। প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী ভালো চাকরি করে টাকা জমিয়ে জমিয়ে শেষ বয়সে টাকার মালিক হয়ে রিটায়ার করার বদলে, তিনি ঠিক করলেন তিনি তখন থেকেই কাজ শুরু করবেন – যেন তিনি অল্প বয়সে ধনী হতে পারেন।

লেখক বলেন, সেই সময়ে তাঁর ধারণা হয়েছিল ধনী হতে হলে হয় তাকে বড় খেলোয়াড়, অভিনেতা, সেলিব্রিটি, অথবা দারুন প্রতিভাবান আবিষ্কারক টাইপের কিছু একটা হতে হবে। কিন্তু পরে তিনি আবিষ্কার করলেন, এসবের আসলে কোনও দরকার নেই। সাধারণ একজন মানুষও কম বয়সে ধনী হতে পারে। এই বিষয়ে সামনে আরও আলোচনা করা হবে।

২য় ভাগ: ধনী হওয়া মানে পথের শেষ নয় – পথ চলা
দ্বিতীয় ভাগে এসে লেখক বলেন, সারাজীবন পরিশ্রম করে টাকা জমিয়ে ধনী হওয়া মানে আপনি আসলে জীবনের খেলায় হেরে গেছেন। এটা করতে গেলে আপনাকে দশকের পর দশক ধরে অন্যের জন্য খেটে যেতে হবে। সম্পদশালী হওয়ার জন্য তরুণ বয়সই আদর্শ সময় – যে সময়টিতে আপনি সম্পদকে উপভোগ করতে পারবেন। পাহাড়ে চড়তে পারবেন, সমুদ্রে সার্ফিং করতে পারবেন, মরুভূমি পাড়ি দিতে পারবেন, প্রিয়জনদের সাথে আনন্দ মুখর সময় কাটাতে পারবেন. এমন আরও অনেক কিছু করতে পারবেন।

বেশিরভাগ মানুষ বিশ্বাস করে যে, দীর্ঘ সময় ধরে একটা কিছু করতে থাকলে এক সময়ে ‘ঘটনা ঘটে’ – পথ চলার শেষে গন্তব্য খুঁজে পাওয়া যায়। মানুষ পথ চলা শেষের ঘটনার দিকে ফোকাস করে, বড় একটি কনট্রাক্ট পাবে, কোম্পানী বিক্রী করবে, লটারি জিতবে – ইত্যাদি ইত্যাদি।

কিন্তু লেখকের মতে, একজন মানুষ চাইলে এই দীর্ঘ পথকে ছোট করে ফেলতে পারে। সময় নয়, কতটা কাজ করা হল, সময়কে কত বেশি কাজে লাগানো গেল – এটাই আসলে আর্থিক সাফল্যের মূল কথা। আপনি যদি ১ ঘন্টায় ১০ টাকার কাজ করেন, তবে ১০ টাকা পাবেন। আর যদি আধা ঘন্টায় ২০ টাকার কাজ করেন – তবে সেটাই পাবেন।

যেসব কাজ করলে সেইসব বিশেষ ঘটনা ঘটে, সেগুলো খুঁজে বের করে, সেই কাজগুলো দ্রুত করতে পারলে বিশেষ ঘটনা – মানে আর্থিক সাফল্যও দ্রুত ঘটবে। কেউ ১০ দিনে ১০০% কাজ সারে কেউ ১০০ দিনে ১০% কাজ সারে।

কাজ করা মানে কিন্তু লেখক এখানে শুধু পরিমানে বেশি কাজ করার কথা বলছেন না।সঠিক পথে ও পদ্ধতিতে কাজ করলে ১০০ দিনের সমান অর্জন ১০ দিনে করা সম্ভব।

লেখকের মতে, মানুষের জীবনের অর্থনৈতিক যাত্রা ৩ ধরনের রোডম্যাপ ধরে চলে: ১. সাইডওয়াক বা ফুটপাথ; ২.স্লো ওয়াক বা হাঁটা পথ; ৩. ফাস্টলেন বা দ্রুত চলার পথ

বইয়ের পরবর্তী ৩টি ভাগে তিনি এই রোডম্যাপগুলো ব্যাখ্যা করেছেন। এবং তারপরের ধাপগুলোতে সবচেয়ে ভালো রোডম্যাপ ধরে পথ চলার পদ্ধতি বাতলেছেন।

৩য় ভাগ: দি সাইডওয়াক
সাইডওয়াকার হল সেই মানুষগুলো যারা শেষ জীবনটা অভাবে কাটাবে। এটা তাদের নিয়তি।

লেখক বলেন, এই ধরনের মানুষ আজকের দিনটা কত ভালোভাবে উপভোগ করা যায় – শুধু তাই নিয়েই চিন্তা করে। উপভোগের পেছনে খরচ করতে তারা ধার করতেও দ্বিধা করে না। পকেটে ৫০০ ডলার থাকলেও তারা লেটেস্ট মডেলের ১০০০ ডলারের আইফোনটি বাজারে নামার দিনেই কিনতে চায় – ধার করে হলেও তাদের এটা লাগবেই।

তারা তাদের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না এবং দীর্ঘমেয়াদের কোনও চিন্তাই করে না। রবার্ট কিওসাকি তাঁর রিচ ড্যাড পুওর ড্যাড বইয়েও একই ধরনের কথা বলেছেন।

সাইডওয়াকার হওয়া একটি বিপজ্জনক ব্যাপার কারণ হঠা‌ত্‍ চাকরি চলে যাওয়া, অর্থনৈতিক মন্দা, চুরি-ডাকাতি, ট্যাক্স ও সুদের হার বৃদ্ধি – ইত্যাদি কারণে এরা পথে বসে যেতে পারে। লেখক বলেন, সাইডওয়াকার মানে কিন্তু গরিব নয়। প্রচুর ধনী মানুষ, যেমন বড় খেলোয়াড়, শিল্পী, অভিনেতা, চাকরিজীবি আছেন যারা সাইডওয়াকার। তারা এমন ভাবে টাকা খরচ করেন যেন আজকের দিনটিই পৃথিবীর শেষ দিন। তাদের এই খরচ চলতেই থাকে, এবং একটা সময়ে গিয়ে যখন ইনকাম বন্ধ হয়ে যায় – তখনই এরা বিপদে পড়েন। মাইকেল জ্যাকসন শত শত মিলিয়ন ডলার কামিয়েছেন – কিন্তু তাঁর খরুচে স্বভাবের কারণে তাঁকে ঋণগ্রস্থ অবস্থায় দিনের পর দিন পার করতে হয়েছে।

লেখক বলেন, শুধু টাকা থাকলেই একজন মানুষ সম্পদশালী হয় না। দামী গাড়ি, বাড়ি, ক্যাশ টাকা থাকলেই মানুষ সুখী হতে পারে না। তাঁর মতে সম্পদ তিনটি বিষয়ের সমষ্টি: সুস্থ দেহ, পরিবার ও বন্ধুর ভালোবাসা, এবং স্বাধনতা। তিনি একে “3Fs” বলেছেন, এগুলো হল, “Fitness, family, freedom”. পূর্ণ স্বাধীনতায় বাঁচার জন্যই আসলে টাকার প্রয়োজন। কিন্তু টাকা ছাড়া বাকি দুটো (স্বাস্থ্য, পরিবার) জিনিসও লেখকের মতে মানুষের সম্পদের অংশ।

সাইডওয়াকারদের আরও একটি বড় সমস্যা হল, এরা নেশা, লটারি, আর জুয়ার মত বিষয়ে জড়িয়ে পড়ে। এমন বহু ধনী সেলিব্রেটি আছে যারা শুধু জুয়ার কারণে শেষ হয়ে গেছে।

একজন সাইডওয়াকারের আজ যতই টাকা থাক, সে যদি স্বভাব না বদলায় – তবে এক সময়ে না এক সময়ে সে আর্থিক ভাবে অসহায় হবেই।

৪র্থ ভাগ: স্লো লেন
এরা সাইডওয়াকারদের পুরো উল্টো স্বভাবের মানুষ। এরা সবকিছুই কালকের নিরাপত্তার জন্য জমিয়ে রাখতে চায়। পিঁপড়া যেমন শীত অথবা বর্ষার জন্য সারা বছর না খেয়ে খাবার গর্তে জমিয়ে রাখে – এরাও তাই। শেষ জীবনের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এরা সারা জীবন যা পায় – সব জমিয়ে রাখতে চায়।

লেখক বলেন – এটাও খুব একটা ভালো পরিকল্পনা নয়। কারণ, সম্পদ উপভোগ করার সেরা সময়ই হল তারুণ্য। সারাজীবন ধরে সরকার বা কোনও প্রতিষ্ঠানের জন্য গাধার মত খেটে হার্টের রোগ, কোমরের ব্যাথা নিয়ে সম্পদ কিভাবে উপভোগ করবেন? তাছাড়া আরও একটি ব্যাপার, টাকার মূল্য সব সময়ে একরকম থাকে না। সময়ের সাথে সাথে টাকার মূল্য কমে। আজ যে জিনিস ১০০ টাকায় পাওয়া যায় ৫ বছর পর তা কিনতে কম করে হলেও ৩০০ টাকা লাগবে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী যারা এভাবে টাকা জমায়, তারা শেষে গিয়ে তাদের সম্পদের মূল্য ৫০% পর্যন্ত হারিয়ে ফেলে। অনেকেই এরকম বিপদে পড়ে। একটা কথা সাধারণ মানুষ বুঝতে চায় না যে, ব্যাংক যে সুদ দেয় তা আসলে একটি ধোঁকা। কয় টাকা কয় বছর পর কত মূল্যবান হবে – এটা তারা ভালো করেই জানে।

এছাড়া সারাজীবন চাকরি করে টাকা জমানোর মানসিকতা আপনাকে সারাজীবনই অন্যের দাস করে রাখবে। আপনি কখনওই সত্যিকার স্বাধীনতা উপভোগ করতে পারবেন না। একটা বয়সের পর নিজের জন্য কিছু করার মানসিকতাই নষ্ট হয়ে যাবে।

অনেকগুলো টাকা ব্যাংকে রেখে যখন আপনি অবসরে যাবেন, তখন দেখবেন সেই টাকা খরচ করে যেসব শখ মেটাবেন ভেবেছিলেন – সেগুলোর রুচিই আপনার নষ্ট হয়ে গেছে।

লেখক আমাদের ভেবে দেখতে বলেন যে, বেশিরভাগ চাকরির পেমেন্টই ডিউটি টাইমের ওপর নির্ভর করে। আপনি চাইলেই দিনে ২৪ ঘন্টার বেশি কাজ করতে পারবেন না। আর ২৪ ঘন্টা কাজ করা কোনও মানুষের পক্ষেই সম্ভব নয়। ওভার টাইম করে টাকা জমাবেন? কয় ঘন্টা ওভারটাইম করবেন? আর সব চাকরিতে এই সুযোগও নেই। ছুটির দিনে এবং ওয়ার্কিং ডে-তে ওভারটাইম করতে গিয়ে আপনি আপনার প্রিয়জনদের সঙ্গ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এই সময়টা আপনি নিজে কিছু শেখার পেছনেও ব্যয় করতে পারতেন, অথবা নিজের ব্যবসা গড়ার কাজে লাগাতে পারতেন। এভাবে হয়তো কিছু বাড়তি টাকা রোজগার হবে – কিন্তু মানসিক ও শারীরিক ভাবে আপনি ক্ষতিগ্রস্থ হবেন।

স্লো-ওয়াক মানসিকতার সবচেয়ে বড় সমস্যা হল, কোনও কারণে যদি আপনার কাজ করার দক্ষতা বা যোগ্যতা নষ্ট হয়ে যায় – তাহলেই আর আপনাকে কারও দরকার হবে না। আপনার বসের সাথে যত ভালো সম্পর্কই থাকুক না কেন – কাজ করতে না পারলে তিনি আপনাকে শুধু শুধু রাখবেন না। ভালো কাজ করে আপনি শুধু আশা করতে পারেন যে, আপনার পজিশন ও বেতন বাড়বে – কিন্তু সেটা অন্যের সিদ্ধান্তের ওপরই নির্ভর করবে। আর, বিশেষ করে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে শুধু পারফর্মেন্স ভালো করলেই হয় না, সাথে আরও অনেক কিছু মেইনটেন করতে হয়।

এইসব কারণে স্লো ওয়াকার হলেই যে শেষ জীবণেও আপনি ধনী হতে পারবেন – এই নিশ্চয়তা দেয়া যায় না।

৫ম ভাগ: ফাস্টলেন রোডম্যাপ
স্লো-লেন পদ্ধতির সমালোচনা করলেও লেখক স্বীকার করেন, ফাস্টলেন পদ্ধতির অনেক আইডিয়াই স্লো লেন থেকে নেয়া। তবে ফাস্টলেন পদ্ধতিতে সময় অনেক কম লাগে। অনেক বেশি স্মার্ট পদ্ধতি এটি। লেখক বলেন, সহজে ধনী হওয়ার কোনও মেথড নেই। এটাও সহজে ধনী হওয়ার মেথড নয়। এটি আপনার ধনী হওয়াকে দ্রুত করবে।

লেখক স্লো-লেন ও ফাস্ট-লেন এর মূল পার্থক্যগুলো বোঝানোর জন্য কয়েকটি পয়েন্ট বলেছেন –

# স্লো ওয়াকাররা বড় অংকের টাকা জমাতে ৩০ বছরের মত সময় নেয়, অন্যদিকে ফাস্টলেন পদ্ধতিতে ১০ বছরের মধ্যেই যথেষ্ঠ ধনী হওয়া সম্ভব।

# স্লো ওয়াকার বা স্লো লেনারদের আয়ের অংক সম্পূর্ণ অন্যের ওপর নির্ভরশীল, অন্যদিকে ফাস্টলেনাররা তাদের আয়ের অঙ্ককে প্রভাবিত করতে পারে। পন্যের দাম বাড়িয়ে, প্রোডাকশন বাড়িয়ে – এবং অন্যান্য আরও উপায়ে।

# স্লো-লেনাররা কর্মচারী, আর ফাস্টলেনাররা মালিক হয়ে থাকে

# স্লো-লেনাররা মিউচুয়াল ফান্ড, স্টক ইত্যাদি ব্যবহার করে ধনী হওয়ার চেষ্টা করে, ফাস্টলেনাররা ধনী হওয়ার পর এগুলো থেকে বাড়তি ইনকাম করার চেষ্টা করেন।

ফাস্টলেনাররা শুরুর দিকে অনেক বেশি পরিশ্রম করে। আপনার ব্যবসার প্রথম ৫ থেকে ১০ বছর অমানুষিক পরিশ্রম করতে হবে। কিন্তু এই অমানুষিক পরিশ্রমের সবচেয়ে ভালো দিক হল, এই সময়টি পার হলে আপনাকে সারা জীবনে আর তেমন পরিশ্রম করতে হবে না। তখন আপনার অধীনে থাকা স্লো-লেনাররা আপনার হয়ে পরিশ্রম করবে। অটোমেটিক ভাবেই আপনার এ্যাকাউন্টে টাকা ঢুকবে – এবং আপনি যা খুশি তাই করতে পারবেন। – তবে প্রথম ৫-১০ বছর উপভোগের কথা একদম ভুলে যেতে হবে। দিনে ১২ থেকে ১৮ ঘন্টা খাটতে হবে।

তবে কঠোর পরিশ্রমই এক্ষেত্রে শেষ কথা নয়। যত কম সময়ের মধ্যে যত বেশি কাজ শেষ করা যায় – সেই দিকে খেয়াল রেখে কাজ করতে হবে। কম সময়ে বেশি কাজ হল এই পদ্ধতির মূল উদ্দেশ্য। স্লো-লেনাররা বেশি টাকার আশায় সময়কে প্রাধান্য দিয়ে কাজ করে, আর ফাস্ট লেনাররা বেশি আউটপুটের জন্য কাজ করে। স্লো লেনাররা যখন এক দিনের কাজকে তিন দিনের কাজ বানিয়ে ফেলে সেখান থেকে বেশি পেমেন্ট এর আশা করে, ফাস্ট লেনাররা তিন দিনের কাজ একদিনে শেষ করে পরের কাজটি দ্রুত শুরু করার চেষ্টা করে। এতে করে তাদের আর্থিক স্বাধীনতা অর্জন দ্রুত হয়।

এর পাশাপাশি ফাস্ট-লেনাররা অন্যদের দিয়েও যত বেশি সম্ভব কাজ করিয়ে নেয়ার একটি পদ্ধতি ঠিক করে নেয়। যাতে যে কাজ করতে তার নিজের ৩ দিন লাগতো, অন্য কয়েকজন মিলে তা এক দিনেরও কম সময়ে শেষ করতে পারে।

ফাস্ট লেনারদের প্রথম দিকের পরিশ্রম থেকে সাধারণত খুব বেশি আর্থিক লাভ হয় না। এটা দেখে স্লো লেনার মানসিকতার লোকেরা অনেক সময়ে তাদের নিয়ে হাসাহাসি করে। কারণ, তাদের মনে থাকে, কাজের পরিমান ও সময়ের হিসাবে একজন মানুষের টাকা পাওয়া উচি‌ত্‍। কিন্তু ফাস্ট লেনাররা যখন তাদের একটি নিজস্ব সিস্টেম দাঁড় করিয়ে ফেলে – তখন হু হু করে টাকা আসতে শুরু করে – হাজারো পরিশ্রম করেও স্লো লেনাররা এত টাকা আয় করতে পারে না।

থিংক এ্যান্ড গ্রো রিচ এর লেখক নেপোলিয়ন হিল বলেন – “একটা নির্দিষ্ট সময় পর সত্যিকার ধনীদের কাছে এমন ভাবে টাকা আসতে শুরু করে – দেখে মনে হয় কেউ জাদু করছে”

এটা আসলে জাদু নয়, সঠিক পথ অবলম্বন করে একটি সিস্টেম দাঁড় করাতে পারলে এমনিতেই এমন ‘জাদু’ হয়। – ফাস্ট লেন এমন সঠিক পথগুলোর একটি।

ফাস্ট লেনার হওয়ার দুই মূল শর্ত: ক) কিছু একটা সৃষ্টি করুন, খ) সময় ও সুদের ওপর নির্ভর করবেন না

ক) কিছু একটা সৃষ্টি করুন

মানুষের জন্ম হয় ভোক্তা বা কনজুমার হিসেবে। আপনার পন্য ও সেবার প্রয়োজন হবে, আপনি সেগুলো চাইবেন, সেগুলো কিনবেন। সবচেয়ে কম দামে সবচেয়ে ভালো পন্যটি পাওয়ার জন্য সবকিছু করতে পারবেন। টিভিতে বা ইন্টারনেটে চটকদার এ্যাড দেখে পন্য কেনার জন্য পাগল হয়ে যাবেন। লিমিটেড এডিশন বা এই ধরনের অফারে প্রলুব্ধ হবেন।

লেখক বলেন, ফাস্ট লেনে যাওয়ার প্রথম শর্তই হল ভোক্তার বদলে নিজেকে বিক্রেতা বা পন্যের স্রষ্টা ভাবা শুরু করা। চাকরি খোঁজার বদলে কিভাবে অন্যদের চাকরি দেবেন – সেই উপায় ভাবতে শুরু করা।

আপনি যখন ভোক্তার বদলে নিজেকে পন্য বা সেবার স্রষ্টা, এবং কর্মচারীর বদলে নিজেকে ভবিষ্য‌ত্‍ কর্মীদের বস হিসেবে দেখতে শুরু করবেন – তখন থেকেই আপনি ফাস্ট লেনের যাত্রী হবেন।

খ) সময় ও সুদের ওপর নির্ভর করবেন না

লেখক বলেন, নিজের সময় ও শ্রমের পরিমানের বিনিময়ে টাকা পাওয়ার চিন্তার বদলে ‘টাকার গাছ’ লাগানোর চেষ্টা করা ফাস্ট-লেনার হওয়ার দ্বিতীয় শর্ত। টাকার গাছ লাগানো মানে এমন একটি সিস্টেম তৈরী করা, যেন আপনি ঘুমিয়ে থাকলেও আপনার ইনকাম হতে থাকে। সাধারণ ভাষায় একে ‘প্যাসিভ ইনকাম’ বা পরোক্ষ আয়ও বলা হয়।

আপনার যদি একটি প্রতিষ্ঠান থাকে, যেখান থেকে খাদ্যদ্রব্য উ‌ত্‍পাদন হয়, এবং সেটি চালানোর জন্য আপনার বিশ্বস্ত কর্মী রয়েছে – তাহলে আপনি না থাকলেও সেখান থেকে পন্য প্রস্তুত হবে এবং আপনার এ্যাকাউন্টে টাকা ঢুকবে।

গাছটি লাগানো থেকে ফল দেয়া শুরু করা পর্যন্ত আপনাকে তার পেছনে অনেক সময় ও শ্রম দিতে হবে – কিন্তু একবার গাছ পরিনত হয়ে গেলে, আপনাকে শুধু মাঝে মাঝে গাছে পানি ও সার দিতে হবে। বাকি কাজ গাছটি নিজেই করবে। মানে, যদি আপনার নিজের একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠান থাকে, এবং সেটি চালানোর জন্য যোগ্য লোক নিয়োজিত থাকে, তবে একটা সময়ে আপনি এমনিতেই গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারবেন। মাঝে মাঝে শুধু কাজের খোঁজ নিলেই চলবে।

লেখক এই ধরনের টাকার গাছের উদাহরণ দিতে গিয়ে, পন্য ও সেবামূলক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ভাড়া দেয়া সম্পত্তি, এ্যাপ ও সফটঅয়্যার, বই, ওয়েবসাইট বা ব্লগ – ইত্যাদির কথা বলেছেন।

হ্যাঁ – এগুলোর উন্নয়ন ও প্রচারের জন্য আপনাকে অবশ্যই সময় দিতে হবে। কিন্তু এর একটি শক্ত ভিত গড়ে দেয়ার পর আপনি আর সারাদিন এর পেছনে সময় দেয়ার জন্য বাধ্য থাকবেন না।

স্লো-লেনাররা ধনী হওয়ার জন্য সুদ ও সময়ের ওপর নির্ভর করে। কারণ তাদের নিজস্ব কোনও প্রতিষ্ঠান বা পন্য থাকে না যেগুলো থেকে নিয়মিত আয় হয়। তারা একটি নির্দিষ্ট পরিমান টাকা ব্যাংকের মত প্রতিষ্ঠানে জমা রাখে – যেখান থেকে নির্দিষ্ট সময় পর পর সুদ আয় হয়। এখানে তাদের নিজেদের কোনও ভূমিকা থাকে না। এই ধরনের আয় বাড়ানোর জন্য আপনাকে আরও টাকা ঢালতে হবে, এবং ইনকামের হার বা শতকরা হিসাব কখনওই বাড়বে না। আপনি যে ব্যাংকে টাকা রাখবেন – সেই ব্যাংকের সুদের নির্দিষ্ট হার অনুযায়ী টাকা বাড়বে । কিন্তু প্রতিষ্ঠান বা পন্য থেকে আয়ের এই ধরনের কোনও সীমা নেই।আজ আপনার কোম্পানী থেকে ১০ টাকা আয় হলে, কাল সেই আয়ই ১০০ টাকা হয়ে যেতে পারে।

এর উল্টোটাও হয় – কিন্তু ফাস্ট-লেনার হতে হলে এই ঝুঁকিটুকু আপনাকে নিতেই হবে। ব্যবসা ও বাজার সম্পর্কে যদি আপনার যথেষ্ঠ জ্ঞান থাকে – তবে ঝুঁকির পরিমানও অনেক কমে আসে।

 

Back to top button