
বেঞ্চগুলো ফাঁকা পড়ে। মন খারাপের ছায়া ক্লাসরুম জুড়ে। যে শিক্ষকের পড়ানো ছাত্রছাত্রীদের টেনে রাখত, তাঁরাই আজ স্কুলে আসা বন্ধ করে দিয়েছেন। তাই, আগের মতো আর সকাল সকাল ঘুম ভেঙে স্কুলে আসছে না পড়ুয়ারা। সারাদিন ধরে মুখরিত থাকা স্কুল এখন নীরব, নিস্তব্ধ।
ঝাড়খণ্ড সীমানা লাগোয়া শাল জঙ্গলে ঘেরা জামবনির পড়শুলি ঝাড়েশ্বর হাইস্কুলের ছবিটা এখন এমনই। ৩৫৭ জন ছাত্রছাত্রীর স্কুলে ১২ জন শিক্ষকের মধ্যে শীর্ষ আদালতের নির্দেশে তিনজনের চাকরি বাতিল হয়েছে। তাঁরা আর স্কুলে আসছেন না। ফলে বাংলা, অঙ্ক ও ভৌতবিজ্ঞানের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ক্লাস কার্যত বন্ধ।
বুধবার দুপুরে স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক সৌরভ বিশ্বাস নবম শ্রেণির ক্লাস নিচ্ছিলেন, যেখানে উপস্থিত ছিল মাত্র দুজন ছাত্র। স্কুল ঘুরে দেখা গেল, কোনো ক্লাসে চারজন, কোনো ক্লাসে পাঁচজন পড়ুয়া। সামগ্রিক চিত্রটা হতাশাজনক। ৩৫৭ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে সেদিন স্কুলে এসেছিল মাত্র ৫৫ জন। সপ্তম শ্রেণিতে ৪৬ জনের মধ্যে ৫ জন, অষ্টমে ৫০ জনের মধ্যে ৮ জন, নবমে ৪৬ জনের মধ্যে ২ জন, দশমে ৫২ জনের মধ্যে ৪ জন এবং দ্বাদশে ৩৬ জনের মধ্যে ২১ জন উপস্থিত ছিল। বাকি পড়ুয়ারা অন্য ক্লাসে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক সৌরভ বিশ্বাস জানাচ্ছেন, স্কুলের ইতিহাসে এমন করুণ চিত্র আগে কখনও দেখা যায়নি।
নবম ও দশম শ্রেণির একমাত্র অঙ্কের শিক্ষক ছিলেন দীপেন বেরা। ভৌতবিজ্ঞানের একমাত্র শিক্ষক ছিলেন অনুপ কুমার করণ। এছাড়াও, নবম-দশমের শিক্ষক হলেও মনোজিৎ মাইতি একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির বাংলা ও শিক্ষাবিজ্ঞান পড়াতেন। এই তিনজন শিক্ষকের চাকরি হারানোর পর স্কুলজুড়ে নেমে এসেছে এক গভীর শূন্যতা। মনোজিৎ মিড-ডে মিলের দায়িত্বও সামলাতেন এবং পড়ুয়াদের সঙ্গে বসে খাবার খেতেন। জানা গেছে, ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল বন্ধুর মতো। এই তিন শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে ক্লাসরুমগুলো ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে বলে জানান সৌরভ বিশ্বাস। তিনি বলেন, “আমাদেরও মনোবল ভেঙে যাচ্ছে।” স্কুলছুট এবং বাল্যবিবাহের আশঙ্কা তাঁকে গ্রাস করছে। তিনি আরও বলেন, “সাধারণত এই এলাকার অনেক ছেলেমেয়ে স্কুলে আসতে চায় না। অনেক অনুরোধে, স্কুলের পরিকাঠামো ও সুবিধা দেখে বাবা-মায়েরা তাদের স্কুলে পাঠান। স্কুলে না এলে নাবালিকা মেয়েদের পরিবারের পক্ষ থেকে বিয়ে দিয়ে দেওয়ার সম্ভাবনাও থেকে যায়। তখন আমরা কী বলে তাদের আটকাব?”
নবম শ্রেণির ছাত্রী সঙ্গীতা মাহাতো ও বাসন্তী হেমব্রমের কথায়, “ঠিকমতো ক্লাস হচ্ছে না বলেই তো অনেকে স্কুলে আসতে চাইছে না। ক্লাস না হলে স্কুলে এসে কী হবে?” দশম শ্রেণির মন্দিরা মাহাতো ও দীপিকা মাহাতো বলে, “মাঝে মাঝে বাংলার ক্লাস হলেও অঙ্ক ও ভৌতবিজ্ঞানের ক্লাস একেবারেই হচ্ছে না। কী ভাবে আমরা মাধ্যমিকে পাস করব? আমাদের তো কোনও গৃহশিক্ষক নেই। স্কুলই আমাদের একমাত্র ভরসা। আমাদের স্যাররা কি আর স্কুলে আসবেন না?”
একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির কলা বিভাগে কোনও স্থায়ী শিক্ষক নেই। নবম-দশমের শিক্ষক এবং পার্শ্বশিক্ষকেরা এই শ্রেণির ক্লাস নিতেন। মনোজিৎ মাইতি ছিলেন তাঁদেরই একজন। তিনি বলেন, “ইচ্ছে থাকলেও যেতে পারছি না। রাজ্য ও কেন্দ্র সরকার এবং বিচার ব্যবস্থার কাছে আমার করজোড়ে অনুরোধ, জটিলতা কাটিয়ে যোগ্য শিক্ষক হিসেবে আমাদের সম্মানের সঙ্গে স্কুলে ফিরিয়ে দিন। ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে এই বিচ্ছেদ প্রতি মুহূর্তে পীড়া দেয়। স্কুল না গিয়ে বাড়িতে থাকাটা আমার কাছে কারাবাসের সমান হয়ে দাঁড়িয়েছে।” শিক্ষক সংকটের এই করুণ চিত্র পড়ুয়াদের ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
ছবি ও তথ্য সৌজন্যে: এই সময়